নিজের শরীরের লক্ষাধিক কোষ দিয়ে বাবার প্রাণ বাঁচাল ছেলে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া (সিএমএল) নামটির সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত নন। তবে সহজ করে ‘রক্তের ক্যানসার’ বললে বিষয়টি বোধগম্য হবে। রক্তের এমন এক ধরনের ক্যানসার, যা শেষ পর্বে গিয়ে ধরা পড়লে রোগীকে বাঁচানোর কোনও সম্ভাবনাই থাকে। এই ক্যানসার ফিরে আসতে পারে বারে বারে। ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুত। এমনই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা নিক মন্ডেক। কেমোথেরাপি ও রেডিয়োথেরাপির পরেও ক্যানসার ছড়াচ্ছিল দ্রুত গতিতে। কিন্তু শেষমেশ সেই মারণরোগকে জয় করেছেন নিক। আর তা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র তাঁর ৯ বছরের ছেলের জন্য। নিজের শরীরের লক্ষাধিক কোষ দিয়ে বাবার প্রাণ বাঁচিয়েছে খুদে।
২০২২ সালে রক্তের ক্যানসার ধরা পড়ে নিকের। তার পর থেকে যমে-মানুষে টানাটানিই চলছিল। কেমোথেরাপি দিয়ে ক্যানসার কোষ পুড়িয়ে দেওয়ার পরেও তা বারে বারেই ফিরে আসছিল। সিএমএলের মূল উপসর্গ হল রক্তাল্পতা। শ্বেতরক্তকণিকাগুলি যখন মায়েলয়েড টিস্যু থেকে অনিয়ন্ত্রিত হারে তৈরি হতে শুরু করে, তখন ক্যানসার এসে হানা দেয়। অধিক মাত্রায় শ্বেতরক্তকণিকা তৈরি হওয়ার ফলে শরীরে রক্ত কমে যায়। রক্তের ক্যানসারের ধরন এক বার নির্ণয় করা গেলে তার পরে চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, রেডিয়োথেরাপি ইত্যাদি। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রোগ নিরাময়ের জন্য অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনও করা হয়ে থাকে। তবে নিকের ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন সফল হয়নি।
চিকিৎসকেরা যখন বোঝেন, আর কোনও উপায় নেই, তখন স্টেম সেল থেরাপি করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে বললেই তো আর এমন থেরাপি করা যায় না! তার জন্য দাতার প্রয়োজন হয়। সেই ভূমিকা নেয় নিকের ৯ বছরের ছেলে স্টিফেন। নিজের শরীরের প্রায় ৬০ লক্ষ স্টেম কোষ বাবাকে দেয় সে। ক্যালিফোর্নিয়ার চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সম্ভবত স্টিফেন এখনও অবধি বিশ্বের কনিষ্ঠতম স্টেম কোষ দাতা, যে নিজের শরীরের কোষ দিয়ে বাবার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
স্টেম কোষ থেরাপি কী?
স্টেম কোষ হল শরীরের এমন এক কোষ, যা থেকে অন্যান্য বহুবিধ কোষ তৈরি করা সম্ভব। অস্থি, তরুণাস্থি থেকে শুরু করে রক্ত এবং লসিকা সংবহনতন্ত্র গঠনে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কোষগুলির রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। স্টেম কোষের উৎস অনেক। সন্তান জন্মানোর পর মায়ের শরীর থেকে যে প্ল্যাসেন্টা বা অমরা বেরিয়ে আসে, তার মধ্যে থাকে স্টেম কোষ, যাকে ‘এমব্রায়োনিক স্টেম সেল’ বলে। আবার মজ্জা থেকেও স্টেম কোষ তৈরি হয়। এই কোষগুলিকে অন্য যে কোনও কোষে বদলে দেওয়া যেতে পারে। যেমন, মজ্জা থেকে নেওয়া স্টেম কোষকে স্নায়ুর কোষে বদলে দেওয়া সম্ভব। আবার এর থেকে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্কের কোষও তৈরি করা যায়। এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াকেই কাজে লাগাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। রক্তের ক্যানসারে রক্তকণিকা উৎপানকারী কোষগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকায়, সে জায়গায় সুস্থ স্টেম কোষ প্রতিস্থাপন করে ক্যানসারের বাড়বৃদ্ধি থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। তবে তার জন্য উপযুক্ত দাতা নির্বাচন করা প্রয়োজন। স্টিফেনের শরীরে যেহেতু নিকের জিন রয়েছে ও রক্তের গ্রুপেও মিল রয়েছে, তাই তার শরীর থেকে নেওয়া স্টেম কোষ ম্যাজিকের মতো কাজ করে। ছেলের সাহায্যেই ক্যানসার যুদ্ধে জয়ী হন বাবা।