প্রতীকী ছবি।
ডোপামিন প্রয়োগ করে সাড়া মিলছে ক্যানসারের চিকিৎসায়! এমনটাই দাবি গবেষকদের। আমেরিকার ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির ওই গবেষকদের দাবি, এই চিকিৎসা সাধ্যের মধ্যে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম। ক্যানসার সংক্রান্ত এই গবেষণায় যুক্ত ছয় সদস্যের তিন জনই বাঙালি। তাঁদের এই পেপারটি প্রকাশিত হয়েছে ‘জার্নাল অব সেল সায়েন্স’ নামে আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে। গবেষণার বিষয়, ডোপামিন হরমোন এবং ক্যানসার আক্রান্ত কোষে তৈরি হওয়া ভাস্কুলার এন্ডোথেলিয়াল গ্রোথ ফ্যাক্টর (ভিইজিএফ-এ) নামক সাইটোকাইন প্রোটিনের মধ্যে লড়াই।
নিউরো ট্রান্সমিটার (স্নায়ু কোষে বার্তা বহনকারী) অথবা নিউরো হরমোন হিসাবে পরিচিত ডোপামিন মূলত ব্যবহার হয় পার্কিনসন্স রোগের চিকিৎসায়। অতীতে ধারণা ছিল, মানুষের মস্তিষ্কই শুধু এই হরমোন তৈরি করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল (জিআই) ট্র্যাক্টে কোলন এবং স্টমাকের এপিথেলিয়াল কোষ, লিম্ফোসাইটের মতো কিছু ইমিউন সেলও ডোপামিনের উৎস।
অন্য দিকে, ভিইজিএফ-এ প্রোটিন ক্যানসার আক্রান্তের শরীরে টিউমারের খিদে মেটাতে অ্যাঞ্জিয়োজেনেসিস পদ্ধতিতে রক্তনালি তৈরি করে। এই সব রক্তনালির মাধ্যমে টিউমারের খাবার পৌঁছয়। তাই ক্যানসারকে প্রতিহত করতে ভিইজিএফ-এ প্রোটিনের কর্মক্ষমতা নষ্ট করা জরুরি। তার ফলে খাদ্য ও অক্সিজেনের জোগান বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটবে টিউমারের।
এই প্রোটিনের কর্মক্ষমতা নষ্ট করতে বাজারে কিছু ওষুধ রয়েছে। কিন্তু সেগুলি দামি ও হাইপারটেনশন-সহ বেশ কিছু গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই চিকিৎসকেরা ওই ওষুধগুলিকে ক্যানসারের অন্তিম পর্যায়ের রোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন।
খরচ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার এই সব জটিলতা এড়াতেই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ডোপামিনকে বেছে নিয়েছেন গবেষকেরা। এই গবেষণায় দেখা গিয়েছে, টিউমারের রক্তনালির এন্ডোথেলিয়াল কোষে ব্যতিক্রমী ভাবে ডোপামিন ডি টু রিসেপ্টর থাকে। যেটি সক্রিয় করলে ভিইজিএফ-এ প্রোটিনের কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়। আবার, এই প্রোটিন স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকে ডোপামিন ডি টু রিসেপ্টরের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ, নিজের মারণাস্ত্র নিজেই তৈরি করে। এই বৈশিষ্ট্যই কাজে লাগাতে চেয়েছেন গবেষকেরা।
গবেষক দলের প্রধান, ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর অব মেডিক্যাল অঙ্কোলজি অ্যান্ড প্যাথলজি অ্যান্ড ডিরেক্টর অব ট্রান্সলেশনাল রিসার্চ সুজিত বসু জানাচ্ছেন, বাজারে ওষুধ হিসাবে কম দামে ডোপামিন বা ডোপামিন ডি টু রিসেপ্টর অ্যাগনিস্ট পাওয়া যায়। ভিইজিএফ-এ প্রোটিনের কর্মক্ষমতা নষ্ট করতে একমাত্র কার্যকর ডোপামিনের এই ডি টু রিসেপ্টর। ডোপামিন বা ডোপামিন ডি টু রিসেপ্টর অ্যাগনিস্ট বাইরে থেকে প্রয়োগ করে টিউমারের এন্ডোথেলিয়াল কোষের ডোপামিন ডি টু রিসেপ্টরকে অতি সক্রিয় করলে নষ্ট হয় ভিইজিএফ-এ প্রোটিনের ক্ষমতা।
গবেষকেরা জানাচ্ছেন, প্রাণীর উপরে এই গবেষণা প্রয়োগের পাশাপাশি কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর টিসু নিয়েও পরীক্ষা চালানো হয়েছে। গবেষক দলের অন্য সদস্যেরা হলেন চন্দ্রাণী সরকার, দেবাঞ্জন চক্রবর্তী, সন্দীপ গোস্বামী, হাও ফ্যান এবং জিয়াকুই মো। গবেষণা-পর্বে প্রত্যেকেই ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে চন্দ্রাণী ও দেবাঞ্জন ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আলাবামায় অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। সন্দীপ সেখানেই পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো।
সুজিতবাবু বলেন, “শুধু কোলন ক্যানসার বা কয়েক ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসাতেই নয়, আরও দু’টি ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেমন, নলজাত শিশুর চিকিৎসায় মহিলাদের ওভারিয়ান হাইপার স্টিমুলেশন সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেই সিনড্রোম এবং মহিলাদের আর একটি সমস্যা এন্ডোমেট্রিয়োসিসের চিকিৎসায় ডোপামিন ডি টু রিসেপ্টর অ্যাগনিস্ট প্রয়োগ করা যায়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম।’’
এই গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে এসএসকেএমের রেডিয়োথেরাপি এবং অঙ্কোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অলোক ঘোষদস্তিদার বলছেন, ‘‘মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি, স্মল মলিকিউল থেরাপি এবং কেমিক্যাল এজেন্ট— এই তিন পদ্ধতিতে ক্যানসার আক্রান্ত কোষকে মারার প্রক্রিয়া প্রচলিত আছে। তবে, সবগুলির ক্ষেত্রেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যথেষ্ট। এই পরিস্থিতি এড়াতে জিআই সেলে (খাদ্যনালির কোষে) ডোপামিনের প্রয়োগ নিঃসন্দেহে টিউমারকে পুষ্টি জোগানোর পদ্ধতি (নিয়ো ভাস্কুলারাইজেশন) আটকাতে পারে। এত দিন ধারণা ছিল, ডোপামিন শুধু মস্তিষ্কের স্নায়ুতেই তৈরি হয়। সেই ধারণার পরিবর্তন হওয়ায় ক্যানসারের চিকিৎসায় এটি একটি নতুন ভাবনা।’’