টাক পড়ার সঙ্গে হার্টের রোগের যোগ। ছবি: সংগৃহীত।
মাথায় টাক পড়ে গেলে কেবল শারীরিক সৌন্দর্য নিয়েই চিন্তায় পড়েন পুরুষেরা। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দাবি উঠেছে, বয়সের আগেই টাক পড়ে যাওয়ার সঙ্গে না কি হার্টের সংযোগ রয়েছে। আপাত ভাবে নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হলেও হার্ট এবং রক্তনালিকা সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। যাঁরা বহু দিন ধরে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন, অথচ চিকিৎসা করাননি, তাঁদের নিয়ে এই গবেষণাটি করা হয়। আথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে ‘পাবমেড জার্নাল’-এ। এতে বলা হয়েছে, যে পুরুষেরা উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করাননি, তাঁদের ধমনী শক্ত হয়ে যাওয়া এবং করোনারি সংক্রান্ত রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে গুরুতর অ্যালোপেসিয়া।
পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তাঁদের হার্টের ছোট ছোট রক্তনালিকাগুলিতে অল্প রক্ত পৌঁছোচ্ছে। আর এই প্রবণতা তাঁদের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যাঁরা পরবর্তী কালে হার্টের রোগে আক্রান্ত হন। যাঁদের চুল ঝরে পড়ার সমস্যা কম, তাঁদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা প্রায় নেই বললেই চলে। রক্তপ্রবাহই যদি ভাল না হয়, তা হলে হার্টের রোগের কবলে পড়তে সময় লাগে না।
অকালে চুল ঝরে টাক পড়ে গেলে কোন কোন বিষয়ে সতর্ক হবেন? ছবি: সংগৃহীত।
গবেষণার দাবির সঙ্গে মেডিসিনের চিকিৎসক অভিজ্ঞান মাঝি সম্পূর্ণ সহমত। তিনি জানাচ্ছেন, টাক পড়ার ঘটনা হার্টের সঙ্গে সম্পর্কিত। কেবল টাক পড়া নয়, পেটে প্রচুর মেদ জমা, চোখের তলায় সাদা সাদা ছোপ পড়া (জ়্যান্থেল্যাজ়মা), কানের লতিতে ভাঁজ পড়া (ইয়ারলোব ক্রিজ়), ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্সের মতো ঘটনাগুলিও হার্টের রোগের ইঙ্গিতবাহী। চিকিৎসক বলছেন, ‘‘চুল পড়ার সঙ্গে হার্টের সরাসরি সম্পর্ক নেই। কিন্তু যে কারণে চুল পড়ছে, সেই কারণটির সঙ্গে হার্টের সম্পর্ক রয়েছে। ছোট ছোট রক্তনালিকাগুলিতে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। চুলের ফলিকলগুলিতে সঠিক পরিমাণে রক্ত পৌঁছোয় না। তার মানে হার্টেও ঠিক মতো রক্ত প্রবেশ করতে পারছে না। অর্থাৎ মাইক্রোভাস্কুলার ডিসফাংশনই এখানে দায়ী। আর মাইক্রোভাস্কুলার ডিসফাংশন হয় এন্ডোথেলিয়াল ডিসফাংশন থেকে।’’ এন্ডোথেলিয়াল ডিসফাংশন একটি ক্ষতিকারক অবস্থা যেখানে এন্ডোথেলিয়াম (রক্তনালিকাগুলির ভিতরের আস্তরণ) সঠিক ভাবে কাজ করে না, যার ফলে রক্তনালির শিথিলতা কমে যায়, প্রদাহ হয় এবং জমাট বাঁধা বৃদ্ধি পায়, যা হার্টের রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে কাজ করে। মাইক্রোভাস্কুলার ডিসফাংশন যে ভাবে চুল ঝরে প়়ড়ার নেপথ্যে কাজ করে, একই ভাবে হার্টের রোগের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায় মাইক্রোভাস্কুলার ডিসফাংশনের কারণে। চিকিৎসক জানাচ্ছেন, মাইক্রোভাস্কুলার ডিসফাংশন ছাড়াও প্রদাহ একটি কারণ। প্রদাহের জন্য টাক প়ড়তে পারে, আবার একই কারণে হার্টের অসুখও হতে পারে। এ ছাড়াও ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স, স্থূলত্বও দু’টি ঘটনার কারণ হতে পারে। তাই এই দু’টি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত।
অভিজ্ঞান মাঝি আরও একটি বিষয়ের কথা তুলে ধরলেন। ডিএইচটি-র উচ্চ মাত্রা বা ডাইহাইড্রোটেস্টোস্টেরন অর্থাৎ অ্যান্ড্রোজেন হরমোন বেড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা পুরুষদের চুল পড়া, ব্রণ এবং প্রোস্টেট বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। এটি হলে করোনারি আর্টারি রোগ হতে পারে।
মেডিসিনের আর এক চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাসের মতে, গবেষণায় বলা হচ্ছে বটে এই ধরনের সমস্যার সঙ্গে হার্টের রোগের সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সব ক্ষেত্রেই এটি সত্য। তবে গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যাঁদের টাক পড়ছে, তাঁদের হার্টে বেশি চাপ পড়ে পেশির আকার বেড়ে যাচ্ছে, রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে এবং মাইক্রোসার্কুলেশন অর্থাৎ ছোট ছোট শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। পাশাপাশি, মস্তিষ্ক, মুখ এবং ঘাড়ে রক্ত সরবরাহকারী ক্যারোটিড আর্টারি আগের তুলনায় পুরু হয়ে যাচ্ছে। এই সব কটি কারণে হার্টের রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকের কথায়, ‘‘অ্যান্ড্রোজেন অর্থাৎ যে হরমোনের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটার কারণে চুল পড়ছে, সেটির সমস্যার কারণেই হার্টে সমস্যা দেখা দিচ্ছে বলে দাবি করছেন গবেষকেরা। এখনও পর্যন্ত সম্ভাব্যের স্তরেই রয়েছে যদিও। নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু টাক পড়ার সঙ্গে ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স, স্থূলত্ব, ইত্যাদির সম্পর্ক রয়েছে। আর এই সবকটিই হার্টের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাতে পারে।’’
অরিন্দম বিশ্বাসের পরামর্শ, টাক পড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে সকলকে। নিয়মিত প্রেশার মাপা থেকে শুরু করে, কাঁচা নুন খাওয়া কমানো, মিষ্টি জাতীয় খাবার থেকে বিরত থাকা খুব দরকার বলে মনে করছেন চিকিৎসক।