ছবি : সংগৃহীত।
রাত ১২টায় ঘুমিয়ে ঠিক ১টায় ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে ধীর পায়ে নেমে এলেন খাওয়ার ঘরে। ফ্রিজ খুলে চিজ়, মাখন, মেয়োনিজ় দিয়ে স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেলেন বা রান্নাঘরে ঢুকে বানিয়ে নিলেন ম্যাগি অথবা স্রেফ আইসক্রিম খেয়েই শান্ত করলেন পেট। তার পরে আবার পা টিপে টিপে চলে এলেন বিছানায়। তার পরে চাদরটি টেনে নিয়ে আরামের ঘুম।
কিংবা সারা দিন খুব নিয়ম মেনে খাওয়াদাওয়া করলেন। কিন্তু দিনের শেষে নৈশভোজের পরে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না। ফ্রিজ খুলে মিষ্টি, রান্নাঘরের মিটশেফ থেকে চানাচুর বাটিতে ঢেলে নিয়ে চলে এলেন বিছানায়। নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজ়নে সিনেমা-সিরিজ় দেখতে দেখতে সাবাড় করে দিলেন খানকতক সন্দেশ, ভাজাভুজি কিংবা প্যাস্ট্রি, প্যাটিস!
এমন অভ্যাসকে স্রেফ বদভ্যাস বা অনিয়ম ভাবলে ভুল করবেন। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াসিট এবং ইউনিভার্সিটি অফ লুইভিলের গবেষণা বলছে, এটি এক ধরনের ‘রোগ’। ইটিং ডিজ়অর্ডার অর্থাৎ খাদ্যাভ্যাসজনিক ব্যাধি। যার নাম নাইট ইটিং সিনড্রোম। এই সমস্যায় আক্রান্তেরা তাঁদের সারা দিনের প্রয়োজনীয় ক্যালোরির একটি বড় অংশ (২৫% বা তারও বেশি) রাতেই গ্রহণ করেন।
লক্ষণ
ঘুম ভেঙে উঠে খাওয়া: এ রোগে যে লক্ষণ মোটামুটি আক্রান্তদের সকলের মধ্যেই দেখা যায়, তা হল মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া। রাতে অন্তত এক বার এবং প্রয়োজন বিশেষে একাধিক বার ঘুম থেকে জেগে উঠে কিছু না কিছু খান এই সমস্যায় আক্রান্তেরা। এ সব ক্ষেত্রে তাঁদের মনে হতে থাকে, না খেলে তাঁরা আর ঘুমোতেই পারবেন না।
প্রাতরাশ না করা: রাতে বেশি খাওয়ার কারণে সকালে স্বাভাবিক ভাবেই খিদে থাকে না। নাইট ইটিং সিনড্রোমে ভোগা মানুষজন অধিকাংশ সময়েই প্রাতরাশ করেন না।
অনিদ্রার সমস্যা: রাতে খাওয়ার প্রবণতা যাঁদের থাকে, তাঁরা প্রায়শই অনিদ্রার সমস্যায় ভোগেন। হয় তারা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন, নয়তো মাঝরাতে খিদে নিয়ে তাঁদের ঘুম ভেঙে যায়।
মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা: অনিয়মিত খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে। প্রভাবিত করে মেজাজ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনকেও। এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষেরা প্রায়শই বিষণ্ণতায় ভোগেন।
কেন হয়?
‘নাইট ইটিং সিন্ড্রোম’ কেন হয়, তার সঠিক কারণ এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে আমেরিকার উইলমিংটন হাসপাতাল এবং নর্থপোর্ট মেডিক্যাল সেন্টারের গবেষণা বলছে, এর নেপথ্যে যেমন কিছু শারীরিক সমস্যা কাজ করে, তেমনই মানসিক সমস্যাও এর কারণ হতে পারে।
দেহঘড়ির সমস্যা: শরীরের নিজস্ব ঘড়ি আছে। যে ঘড়ি অ্যালার্ম না বাজলেও সকাল হলে চোখ খুলিয়ে দেয়। দুপুরে খাওয়ার সময়ে খিদে পাওয়ায়। সারা দিন জাগিয়ে রাখে আর রাতে ঘুমোনোর সময়ে জুড়িয়ে দেয় চোখ। সারা দিনের কাজকর্মকে বেঁধে রাখে নিয়মের ছন্দে। সেই ঘড়িকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘সার্কাডিয়ান রিদম’। সহজ ভাষায়, ‘দেহঘড়ি’। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, যাঁদের ‘নাইট ইটিং সিনড্রোম’ রয়েছে, তাঁদের দেহঘড়ি ঠিকমতো কাজ করে না। রাত্রিবেলা তাঁদের শরীরে এমন কিছু হরমোন নিঃসৃত হয়, যা তাঁদের খিদের বোধকে বাড়িয়ে তোলে। বাড়িয়ে দেয় সজাগ থাকার অনুভূতিও। যা আদতে দিনের বেলায় হওয়ার কথা। কিন্তু দেহঘড়ির ভুলে সেই সবই হতে থাকে রাতে।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা: গবেষণায় দেখা গিয়্ছে যে, নাইট ইটিং সিনড্রোমে যাঁরা ভোগেন, তাঁদের শরীরে মেলাটোনিন (ঘুমের হরমোন) এবং লেপটিন (খিদে কমানোর হরমোন) -এর মাত্রা কম। সে জন্যই তাঁদের রাতের বেলায় ঘুম হতে চায় না এবং খিদে পায়।
হতাশা বা মানসিক সমস্যা: তীব্র মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগে ভুগলে বা কোনও কারণে বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকলেও এই রোগ দেখা দিতে পারে। এই ধরনের সমস্যা অনেক ক্ষেত্রে রাতে আরও বাড়ে। খাওয়াদাওয়া সেই মানসিক অস্বস্তি থেকে সাময়িক মুক্তি দেয় বলে তাঁরা সেই অভ্যাসকে আঁকড়ে ধরেন।
খাবারে অস্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ: যাঁরা দিনভর কম ক্যালোরির খাবার খান বা কড়া ডায়েট মেনে চলেন, দিনের শেষে শরীরে ক্লান্তি ভর করলে তাঁদের সেই রাশ আলগা হয়। বাড়ে অতিরিক্ত খিদে পাওয়ার এবং এটা-সেটা খাওয়ার প্রবণতা। যা দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকলে নাইট ইটিং সিনড্রোম হতে পারে বলে মনে করেন তারকা পুষ্টিবিদ রায়ান ফার্নান্দো।
জেনেটিক কারণ: কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বংশগত কারণেও নাইট ইটিং সিনড্রোম হতে পারে, অর্থাৎ পরিবারের যদি কারও এই সমস্যা থাকে, তবে তাঁর বংশধর বা পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।