Rainfall Sound Therapy

একটানা বৃষ্টির শব্দ যেন ঘুমপাড়ানি গান, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমাতে কৃত্রিম উপায়ে জলের শব্দ শোনা হচ্ছে কেন

মিউজ়িক থেরাপির রমরমার যুগে, সাউন্ড থেরাপিও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। আর বৃষ্টির শব্দ চালিয়ে মন শান্ত করার চল দেখা যাচ্ছে নতুন যুগে। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন জাগে, কেন ঝোঁক বাড়ছে? কাজ দিচ্ছে কি? কী ভাবে কাজে আসছে তা?

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৫ ১০:৪০
Share:

বৃষ্টির শব্দেই মনের আরাম। ছবি: সংগৃহীত।

‘টাপুর টুপুর’, ‘ঝিরঝির’, ‘টিপটিপ’, ‘রিমঝিম’, ‘ঝমঝম’— একনাগাড়ে বৃষ্টি আর বৃষ্টি। সারা রাত। একেবারে কানের কাছে। যত ক্ষণ আপনি চাইবেন, তত ক্ষণই চলবে বারিধারা। বেশি নয়, কমও নয়। যে গতিবেগে প্রযুক্তি এগোচ্ছে, তাতে প্রকৃতিকে হাতের মুঠোয় নেওয়া আর এমনকি কঠিন ব্যাপার! আর তাই গান শোনার যে নানাবিধ ডিজিটাল মাধ্যম রয়েছে, তার সাহায্যেই বৃষ্টিকে নিজের কব্জায় আনতে পারেন। নিজের পছন্দমতো সময়ে, যত ক্ষণ পর্যন্ত ইচ্ছে, যেমন তীব্রতা প্রয়োজন, তেমনই বৃষ্টি নামাতে পারবেন। না, তার জন্য তানসেন হওয়ার প্রয়োজন নেই, একটি স্মার্টোফোনই যথেষ্ট। মিউজ়িক থেরাপির রমরমার যুগে, সাউন্ড থেরাপিও বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। আর বৃষ্টির শব্দ চালিয়ে মন শান্ত করার চল দেখা যাচ্ছে নতুন যুগে। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন জাগে, কেন ঝোঁক বাড়ছে? কাজ দিচ্ছে কি? কী ভাবে কাজে আসছে তা?

Advertisement

ইউটিউব হোক বা স্পটিফাই, মনে প্রশান্তি আনার জন্য বা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমানোর জন্য কিংবা ঘুম পাড়ানোর জন্য বৃষ্টির একঘেয়ে, একটানা আওয়াজই নাকি ওষুধসম। তালিকায় পাওয়া যায় অগুন্তি অডিয়ো ক্লিপ। কোথাও ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কোথাও ঝমঝমিয়ে, কোথাও বা থেমে থেমে জলের ধারা, কোথাও বা একটানা। সঙ্গে আবার সঙ্গত করতে কোনওটিতে কড়কড়িয়ে বাজ পড়ছে, কোথাও বা মেঘ কেবল গুড়গুড় করেই ক্ষান্ত দিচ্ছে। বৃষ্টির পসরা যেন। যেমনটা পছন্দ, তেমনটাই কিনে নেওয়া যাবে। তাও আবার বিনামূল্যে (ইন্টারনেটের মাসুল অবশ্য আলাদা)। কিন্তু নতুন যুগের আজব কায়দা বলে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়। এর যোগসূত্র রয়েছে শরীর ও মনের ভিতরে। অন্তত তেমনটাই দাবি স্নায়ুরোগ এবং নিউরোরিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের চিকিৎসক সুপর্ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের। তিনি বলছেন, ‘‘প্রাকৃতিক শব্দ, পাখির আওয়াজ, বৃষ্টির আওয়াজ, নদী বয়ে যাওয়া অর্থাৎ জলের আওয়াজ যে মানুষের মন ভাল করতে পারে, তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে। বুদ্ধিমত্তা, বোঝার ক্ষমতা, অনুভূতি ব্যক্ত করা ইত্যাদি অবস্থার উন্নতি করে। আমরা রিহ্যাবে রেখে যে রোগীদের মিউজ়িক থেরাপি করাই, ঠিক তেমন ভাবেই সাউন্ড থেরাপি নিয়েও কাজ করি। বাড়িতে রোগীদের প্রাকৃতিক শব্দ যাতে শোনানো হয়, তেমন বন্দোবস্ত করার কথা বলা হয়। এর বেশ কয়েকটা কারণ রয়েছে।’’

চিকিৎসকের মতে, স্ট্রেস হরমোন অর্থাৎ কর্টিসল কমাতে পারে একটানা বৃষ্টির শব্দ। ফলে মন শান্ত হয়। উদ্বেগের সমস্যা কমায়। উৎকণ্ঠার সময়ে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। বুকে চাপ চাপ লাগে। তখন এমন শব্দ কানে একটানা বাজতে থাকলে পালস রেট স্বাভাবিক হয়। এমনকি আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনে থাকা রোগীর উৎকণ্ঠা কমাতেও তা সাহায্য করে। ঘুমের সময়ে বৃষ্টির আওয়াজ শুনলে গভীর হয় ঘুম। ফলে মস্তিষ্ক বেশি সক্রিয় থাকে। অবসাদের সময়েও মনকে আরামও দিতে পারে। বিরক্তি কমিয়ে ঠান্ডা করতে পারে শরীর ও মনকে। চিকিৎসক জানালেন, বৃষ্টির আওয়াজ বা প্রাকৃতিক শব্দের উপকারিতা নিয়ে অনেক গবেষণাও রয়েছে।

Advertisement

একটানা বৃষ্টির শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে থেরাপি হিসেবে। ছবি: ফাইল চিত্র।

যেমন ২০১৮ সালে ‘পাবমেড’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র পড়লে দেখা যাবে, নীরবতার তুলনায় সঙ্গীত এবং বৃষ্টির শব্দ (কখনও সখনও অন্যান্য প্রাকৃতিক শব্দ) মানুষের মনে আশ্চর্য পরিস্থিতি তৈরি করছে। যাঁদের নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাঁদেরকে কঠিন অঙ্ক কষতে দেওয়া হয়। কারও সঙ্গী নীরবতা, কারও বা সঙ্গীত, কারও আবার ভারী বৃষ্টির শব্দ। সেখানে স্পষ্ট দেখা যায়, পরের দুই পরিস্থিতিতে গাণিতিক সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বেড়ে যাচ্ছে। যেমন ভাবে ২০১৯ সালে জাপানের আইচি ইউনিভার্সিটি অফ এডুকেশনের পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, এগুলির ব্যবহারে মেজাজ উন্নত হয়, স্নায়বিক কার্যকলাপ উন্নত হয়, কর্টিসল ক্ষরণের মাত্রা কমে।

নানাবিধ বৈজ্ঞানিক গবেষণা হলেও বৃষ্টির আওয়াজকে বিজ্ঞান হয়তো সঙ্গীতের আওতায় ফেলেনি। কিন্তু বৃষ্টিপাতের সঙ্গে যে সমস্ত ধন্যাত্মক শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়, তাকে আবার কেবল কোলাহল বা ‘নয়েজ়’ বললে অপমান করা হয়। তা সে ‘টাপুর টুপুর’ই হোক বা ‘ঝমঝম’। ঠিক যেমন ভাবে পদার্থবিজ্ঞানী, কবি, শব্দবিজ্ঞানের গবেষক শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কাছে বৃষ্টির আওয়াজ বড়ই সুরেলা। তাঁর মতে, পদার্থবিজ্ঞানে হয়তো গাড়ির আওয়াজও নয়েজ়, আবার বৃষ্টির আওয়াজও নয়েজ়। কিন্তু মানুষের কানে কোনটি কী ভাবে যায়, সেটিই হচ্ছে আসল। তাঁর ভাষায় বললে, ‘‘বৃষ্টির শব্দ এ ভাবে শোনা যায়, এমন কথা তো আমি জানতামই না। কিন্তু ভেবে দেখলে, বেশ ভাল লাগছে। আমাদের মতো দেশে বৃষ্টির দিনে কী সুন্দর ঘুম হয়, তাই না? তা হলে যদি বৃষ্টির শব্দের অবিকল শব্দ তৈরি করা যায়, তা তো সত্যিই আরামের। খুব একঘেয়ে ঠিকই, কিন্তু এখানে দু’টি বিষয় রয়েছে।’’

প্রথম, বর্ষীয়ান কবি, বিজ্ঞান ভাবুক তুলে আনলেন ‘ফোরিয়ার অ্যানালিসিস’-এর কথা। বিজ্ঞানী জোসেফ ফোরিয়ারের আবিষ্কৃত তত্ত্ব। তাই এমন নাম। বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, বৃষ্টির শব্দ কিন্তু একটি মাত্র শব্দ নয়। তাকে ভাঙলে একাধিক শব্দ পাওয়া যাবে। বৃষ্টির শব্দকে ভাঙলে অনেকগুলি মৌলিক তরঙ্গ পাওয়া যাবে। আমরা যা শুনতে পাই, তা হল শব্দতরঙ্গের সমষ্টি। এর ভিতরে কী কী আছে, দেখলেই বোঝা যাবে, নিছক কোলাহল নয় বৃষ্টি। তাঁর কথায়, ‘‘দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়ে যদি বলি, মানুষ কিন্তু এক দিনে গড়ে ওঠেনি। গোটা মানবজাত অনাদি, অন্তত কাল ধরে বিশ্বকে দেখে আসছে। আদিম যুগে বন্য পরিবেশে, ঘন বৃষ্টিতে, গভীর শীতে, তীব্র গরমে কী ভাবে দিন কাটিয়েছে, তার স্মৃতিতে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে সে সব লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। মানুষ সে সব শব্দকে আসলে ভালবাসে, যেগুলির সঙ্গে তার নাড়ির টান রয়েছে। মানুষের হৃদয়ে কিন্তু অস্তিত্বের ইতিহাস বিরাট প্রভাব ফেলে। আর সেখান থেকেই হৃদয় আরাম পায় সেই শব্দগুলিতেই।’’ ঠিক যে ভাবে অনেকে শৈশবের কথা বলতে ভালবাসেন, তেমন ভাবেই এই সূত্রের কার্যকারণ ব্যাখ্যা করলেন বর্ষীয়ান পদার্থবিজ্ঞানী। এক একটি সুর এক এক স্মৃতির ভার বহন করে। এক এক রাগ-রাগিনী মনের ভিন্ন ভিন্ন মেজাজ সৃষ্টি করতে পারে। বাহার থেকে মল্লার, সবেতেই ছোট্ট নোটের এদিক-ওদিকে বদলে যেতে পারে গোটা ঋতুর চরিত্র। তাই সঙ্গীতের সঙ্গে যে ভাবে মনের ভাবের সম্পর্ক, সে ভাবেই বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক শব্দের সঙ্গেও আত্মার যোগাযোগ।

সুতরাং, ওষুধ খেয়ে উদ্বেগ কমানো বা বিভিন্ন হিলিং প্রোগ্রামের পিছনে টাকা খরচ করার মানেই হয় না! কেবল হেডফোন ইয়ারফোন থাকলেই মনের নির্দিষ্ট কয়েকটি অসুখকে চিরতরে বিদায় জানানো যাবে। তাই কি? বিজ্ঞানী বললেন, ‘‘রোজ সকাল থেকে রাত একই আওয়াজ কানে এলে তো বিরক্ত হয়ে যাবে মানুষ! ঠিক যেমন নতুন কোনও গান পছন্দ হওয়ার পর বারে বারে চালিয়ে শুনলে একটা সময় পর তাতে পচন ধরে যায়।’’ চিকিৎসক জানালেন, অতিরিক্ত উদ্দীপক কিন্তু মানসিক রোগীদের জন্য একেবারেই ভাল নয়। যে ভাবে তাঁদের রিহ্যাবে মনোবিদদের সুপারিশ করা নিয়মেই কেবল এই ধরনের থেরাপি করানো হয়। অল্প অল্প সময়ে। একটানা বেশি ক্ষণ নয়। রিহ্যাবের রোগী না হলেও পরিমিতিবোধ থাকা উচিত। নয়তো উপকার মোটেও মিলবে না। বাকিদেরও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিলেন তিনি। যে বৃষ্টির আওয়াজ আজ মধুর, তা-ই কাল অসহ্য হয়ে উঠবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement