— প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
গ্রামের ক্ষৌরকারের কাছে চুল কাটালেন দলিত যুবক! লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, পাশের গ্রামে গিয়ে নয়— এক্কেবারে নিজের গ্রামে, তা-ও প্রকাশ্য দিনের আলোয়। ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এমনই ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকল গুজরাতের আলওয়াড়া গ্রাম।
শুনে মনে হতে পারে, এ আর এমন কী! শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি, স্বাধীনতার পর গত ৭৮ বছরে এমন নজির দেখা যায়নি আলওয়াড়ায়। এত দিন চুলদাড়ি কাটার জন্য পায়ে হেঁটে পাশের গ্রামে যেতে হত গ্রামের দলিতদের। কারণ, ক্ষৌরকারদের দিয়ে চুল কাটানোর ‘অধিকার’ রয়েছে কেবল উচ্চবর্ণের। তেমনটাই নাকি দস্তুর। চিরাচরিত সেই প্রথা ভেঙে গত ৭ অগস্ট নিজের গ্রামের সেলুনে বসেই চুল কাটালেন ২৪ বছরের তরুণ কীর্তি চৌহান— এত বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বার আলওয়াড়ার ক্ষৌরকারের দোকানে পা পড়ল কোনও দলিতের!
২৪ বছরের কীর্তি পেশায় কৃষিশ্রমিক। গুজরাতের বনসকাটা জেলার ছোটখাটো এই গ্রামের বাসিন্দা কীর্তি ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছেন বৈষম্যের এই নগ্ন ছবি। এই গ্রামে বংশপরম্পরায় স্থানীয় ক্ষৌরকারেরা দলিতদের চুল কাটেন না। তাঁদের দিয়ে চুলদাড়ি কাটানোর ‘অধিকার’ পান কেবল উচ্চবর্ণভুক্তেরা। সংবাদমাধ্যম টাইম্স অফ ইন্ডিয়া-র একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলওয়াড়ায় প্রায় ৬,৫০০ মানুষের বাস। তার মধ্যে অন্তত ২৫০ জন দলিত। বাধ্য হয়ে চুল কাটানোর জন্য তাঁদের সকলকে যেতে হয় আশপাশের গ্রামগুলিতে। কখনও কখনও দূরের গ্রামে চুল কাটাতে গেলেও নিজের জাত গোপন রাখতে হয়, পাছে জানাজানি হলে সেখান থেকেও গলাধাক্কা মেলে! এ ভাবেই বছরের পর বছর ধরে বেঁচে আছেন আলওয়াড়ার দলিতেরা। জ্ঞান হওয়া ইস্তক তেমনটাই দেখে আসছেন কীর্তি।
এ সবের মাঝে হঠাৎ যখন গ্রামের সেলুনে চুল কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন কীর্তি, পাশে দাঁড়ান গ্রামের দলিতদের একাংশ। সরব হন সমাজকর্মীরাও। ‘সাহসী’ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। সামান্য চুল কাটানোর জন্য কম কাঠখড় পোয়াতে হয়নি কীর্তিদের! দলিতদের হয়ে মাঠে নামেন স্থানীয় সমাজকর্মী চেতন দাভী। ঘরে ঘরে গিয়ে উচ্চবর্ণ এবং ক্ষৌরকারদের এই প্রথার অসাংবিধানিকতা সম্পর্কে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেন চেতন। শুরুতে কথায় কাজ না হওয়ায় পুলিশ এবং জেলাপ্রশাসন হস্তক্ষেপ করে। গ্রামের মোড়লদের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়। শেষমেশ হার মানেন উচ্চবর্ণেরা। গ্রামের মোড়ল সুরেশ চৌধুরী অতীতের বৈষম্যের জন্য দুঃখপ্রকাশও করেন। চুল কাটান কীর্তি!
এত লড়াইয়ের পর কীর্তি কী বলছেন? তরুণের কথায়, “নিজের ২৪ বছরের জীবনে এই প্রথম বার আমি আমার নিজের গ্রামের এক সেলুনে বসলাম! আগে সব সময় আমাদের চুলদাড়ি কাটাতে অন্যত্র যেতে হত। সে দিন, আমি আমার নিজের গ্রামে স্বাধীন বোধ করেছি। নিজেকে আর ‘বাইরের লোক’ মনে হয়নি।”
গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের আর এক প্রতিনিধি ৫৮ বছর বয়সি ছোগাজি চৌহান জানাচ্ছেন, আলওয়াড়ার এই প্রথা আজকের নয়। তাঁর পূর্বপুরুষেরা স্বাধীনতার আগেও এই বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। গত আট দশক ধরে একই চিত্র দেখে আসছেন ছোগাজির সন্তানেরাও। দশকের পর দশক ধরে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছিল। তবে অগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে দৃশ্যটা খানিক বদলেছে। এখন গ্রামের পাঁচটি সেলুনেই ধীরে ধীরে দলিত খদ্দেরদের আনাগোনা বেড়েছে। মেনে নিয়েছেন ক্ষৌরকারেরা এবং উচ্চবর্ণের লোকেরাও। কীর্তির চুল কাটা ২১ বছর বয়সি পিন্টুর কথায়, ‘‘সমাজ যা বলত, আমরা আগে তা-ই মেনে চলতাম। কিন্তু এখন যেহেতু গ্রামের বড়রা এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছেন, তাই আমাদের আর কোনও আপত্তি নেই। এতে আমাদের ব্যবসাতেও লাভ হচ্ছে।’’ গ্রামের উচ্চবর্ণের প্রকাশ পটেল আবার বলছেন, “আমার মুদি দোকানে সব খদ্দেরদের স্বাগত জানানো হয়। তা হলে সেলুনে কেন নয়? এটা ভাল যে এত দিনে এই অন্যায় প্রথার অবসান ঘটল।”
তবে লড়াই এখানেই শেষ নয়। গ্রামেরই দলিত এক কৃষক ঈশ্বর চৌহান বলেন, ‘‘আজ আমরা সেলুনে ঢোকার অধিকার পেয়েছি, কিন্তু এখনও নিমন্ত্রণে কিংবা ভোজে আমাদের আলাদা বসতে বাধ্য করা হয়। হয়তো একদিন সে সব প্রথারও অবসান হবে।’’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে শেকল কীর্তির পূর্বসূরিরা বয়ে চলেছেন, তা ভাঙা সহজ নয়। তবু, আপাতত এ টুকুতেই আশার আলো দেখছেন আলওয়াড়ার দলিতেরা।