রাষ্ট্রপতি ভবনের সকলেই ‘ফার্স্ট লেডি’-কে ডাকতেন ‘মা’ বলে।
অভূতপূর্ব ‘ভোজন-বিপ্লব’ রাইসিনার রান্নাঘরে। ফার্স্ট লেডির তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রপতি ভবনে তৈরি করা হল তালের বড়া! তবে প্রোটোকল অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি-পত্নী রান্নাঘরে ঢুকবেন না! তা সে যাই হোক না কেন, কোনও বাঙালি সুগৃহিণী ভাদ্র সংক্রান্তিতে তালের বড়া করে খাওয়াবেন না তাঁর পরিবারকে, সে কি হয় নকি! নিজে রান্নাঘরে না-ঢুকেও তাই পুরনো রাঁধুনি অষ্টমীকে নির্দেশ দিয়ে তালের বড়া তৈরি করালেন শুভ্রা মুখোপাধ্যায়।
পঞ্জিকা অনুসারে সে দিন শুভ্রাদেবীর জন্মদিনও বটে। তবে তা পালিত হল ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী, সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর। ফার্স্ট লেডিকে ‘সারপ্রাইজ’ দিলেন রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মীরা। উপহার দিলেন স্ট্রবেরি কেক। সর্বস্তরের কর্মীদের উপস্থিতিতেই অনাড়ম্বরে, সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে জন্মদিন পালিত হল। সকলের অনুরোধে ফুঁ দিয়ে মোমবাতিও নেভালেন। স্বামী, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে।
এই বাড়ির রান্নাঘরের খোলনোলচে বদলে দিয়েছিলেন ফার্স্ট লেডি
রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণের দিন বিকেলে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রবেশ করে মুখুজ্জে পরিবার। তালকাটোরা রোডের দীর্ঘ দিনের সংসার গুটিয়ে এসে তাঁরা ঢুকেছেন মোট দু’লক্ষ স্কোয়ার ফুট এলাকার এই বিশাল প্রাসাদে। ব্রিটিশ স্থপতি এডউইন ল্যান্ডসিয়ার লুটেন্সের নকশা করা এই ভবনটিতে মোট ৩৩০টি ঘর। যার মধ্যে ১২৫টি ঘর নাকি রাষ্ট্রপতির পরিবারের ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ! ভবনটির কাজ ১৯১২ সালে শুরু হয়ে ১৯২৯ সালে শেষ হয়। ব্রিটিশ ভাইসরয়ের বাসভবন হিসাবে নির্মিত এই প্রাসাদে ১৯৩১ সালে প্রথম বাস করতে আসেন লর্ড আরউইন।
পাঠক হয়ত ইতিহাসের কচকচানিতে একঘেয়ে বোধ করছেন। কিন্তু ইতিহাসকে, অতীতকে বাদ দিয়ে এই প্রতিবেদন লিখলে তা বাঙালির শীর্ষ জয়ের সাফল্যের মহিমাকে খর্ব করবে বলে মনে হয়। ভেবে দেখুন তো, ১৯১২ সালের দিল্লি। সদ্য এই নগর পেয়েছে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীর স্বীকৃতি। আর সেই মাহেন্দ্র ক্ষণে সাবেক দিল্লির সংলগ্ন রাইসিনা ও মালচা গ্রামের চার হাজার একর জমিতে শুরু হচ্ছে অধুনা রাষ্ট্রপতি ভবনের নির্মাণ পরিকল্পনা। তার ঠিক একশো বছর পরে পরতে পরতে ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িয়ে থাকা এই ভবনের সর্বময় কর্তা হয়ে ঢুকেছেন বীরভূমের মিরাটি গ্রামের এক ভূমিপুত্র, এক বাঙালি। আর সেই সঙ্গে সমস্ত বাঙালিও যেন পৌঁছে যান রাইসিনা হিলের শীর্ষে!
আরও পড়ুন: দক্ষিণের বাড়ি
কেমন করে সময় কাটছে রাইসিনা হিলের কর্তার? বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা-সাড়ে ৮টা পর্যন্ত অফিস। অর্থমন্ত্রকে যেমন করতেন, প্রায় সেই রকম। ফাইলের চাপ একটু কম। তবে রোজ ১৫/২০টা ফাইল দেখতেই হয়। ক্যাবিনেটের কাগজপত্রের কপি, এক্সিকিউটিভের কাগজপত্র, বিচার বিভাগের থেকে ক্ষমা প্রার্থনার আর্জি। রোজই অনুষ্ঠান থাকে। এই তো বিজ্ঞানভবনে মোতিলাল নেহরুর সার্ধশতবর্ষ করে এলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সমাবর্তনেও তাঁকে যেতে হয়। জম্মু কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উপলক্ষে কাশ্মীর সফরও তাঁর কর্মসূচিতে। রাষ্ট্রদূতেরা আসেন সাক্ষাৎ করতে। রাষ্ট্রপতি ভবনে অভ্যন্তরীণ অনুষ্ঠান হয়। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সচিব প্রদীপ গুপ্তা জানালেন, ২০০৪ সাল থেকে ওঁর সঙ্গে রয়েছেন তিনি। এখনও ‘স্যর’ আগের ছন্দেই কাজ করে যান। অবসর সময় একটু বেড়ে যাওয়ায় বই পড়াও বেড়ে গিয়েছে।
৬৬তম প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ভবনে ওবামা দম্পতির সঙ্গে সস্ত্রীক প্রণব মুখোপাধ্যায়
এখন সম্ভবত পড়ছেন ধর্ম সংক্রান্ত কোনও বই। শুভ্রাদেবী জানালেন, এখনও সকাল ৬টা-সাড়ে ৬টায় মর্নিং ওয়াকে যান। ডায়েটেও পরিবর্তন নেই। এ দিকে, বাঙালিয়ানা ঢুকে গিয়েছে মুঘল-সহ ভারতীয় ও ইউরোপীয় স্থাপত্যের অপূর্ব সমন্বয়ে তৈরি এই প্রাসাদে। মেনুতে এখন আলুপোস্ত, পুঁটিমাছ। প্রধান পাচক মির্জা নাফিজ বেগ থেকে শুরু করে বাটলার নরেশকুমার, সকলেই ‘ফার্স্ট লেডি’-কে ডাকছেন ‘মা’ বলে। সেই ‘মা’ ইতিমধ্যে মুঘল গার্ডেন্সের মাটিতে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলার গন্ধ। ১১টি স্থলপদ্মের চারা লাগিয়েছেন তিনি। “আশ্চর্য, এঁরা এখানে স্থলপদ্মের নামই শোনেননি”- আফসোসের সঙ্গে জানালেন ফার্স্ট লেডি। এ বার অজস্র গোলাপ, টিউলিপ, লিলির পাশাপাশি শ্বেত-গোলাপি স্থলপদ্ম মুঘল গার্ডেন্সের শোভা বাড়াবে। তাঁর বাল্যের স্মৃতি বিজড়িত হিজল গাছের চারাও লাগাতে চান ‘মা’। তবে হয়ে উঠছে না তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘গীতাঞ্জলি’ ট্রুপের অনুষ্ঠানে গান গাওয়া। কারণ প্রোটোকল ‘ফার্স্ট লেডি এন্টারটেইন করতে পারেন না, এন্টারটেইন্ড হতে পারেন’। রাষ্ট্রপতির কাছে হালকা ভাবে এই প্রশ্ন রেখেছিলাম, রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে তিনি কি এই প্রোটোকলের ব্যাপারে কিছু করতে পারেন না? তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন হাসি, সঙ্গে উত্তর “ওর শরীরটাই তো ভাল যাচ্ছে না।” প্রোটোকলের আর একটা মজার গল্প আছে। ফার্স্ট লেডির অপূর্ব কারুকাজ করা খাটে, যে খাটে এক সময় স্বয়ং রানি এলিজাবেথ শুয়ে গিয়েছেন, বসলে তিনি ঠাট্টাচ্ছলে বলেন, “খাটে বসছিস, উঁহু প্রোটোকল আছে।” একান্ত ঘরোয়া-আন্তরিক পরিবেশ সেই ঘরে। প্রোটোকলের কোনও স্বাদগন্ধও নেই।
তবে প্রোটোকল আছে অন্যত্র। রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢোকা থেকে বেরনো নিয়মের ঘেরাটোপে মোড়া। রাষ্ট্রপতি ভবনে ফার্স্ট লেডির অতিথি হয়ে ছিলাম দু’দিন। চার দিনের দিল্লি সফরের বাকি দু’দিনও গিয়েছি দেখা করতে। প্রতিবারই কড়া নিরাপত্তার বেড়াজাল পার হতে হয়েছে।
আরও পড়ুন: ইন্দিরা গাঁধীই দিয়েছিলেন ‘গীতাঞ্জলি’ নামটা
ইন্ডিয়া গেটকে পিছনে ফেলে নাক বরাবর যত এগোবেন ততই চোখের সামনে ফুটে উঠবে রাষ্ট্রপতি ভবন। আগে থেকেই জানিয়ে দিতে হয়েছিল গাড়ির নম্বর। দু’পাশে প্রাচীর দেওয়া পথের শেষে নিরাপত্তারক্ষীদের ছাউনি পেরিয়ে ভবনের দফতর থেকে নির্দিষ্ট করা গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে চোখে পড়ে জয়পুর কলাম। গাড়ি গিয়ে দাঁড়ায় ফোরকোর্টে। ছবি তুলে এন্ট্রি পাশ প্রস্তুত করার পরে তল্লাশি। ক্যামেরা, মোবাইল ফোন, টেপরেকর্ডার নৈব নৈব চ। বিমানবন্দরের মতো দেহতল্লাশি। অবশেষে ছাড়পত্র হাতে নিয়ে রক্ষীর সঙ্গে অন্দরে প্রবেশ। লিফটে করে দোতলায়, ফার্স্ট লেডির মহলের দিকে। এখানে রাজস্থানের প্রাচীন দুর্গের মতো খোলা চত্বর। তা পেরিয়ে ফার্স্ট লেডির মহল। প্রতি মহলে আলাদা প্রহরী। অলিন্দে একটু দূরে দূরে ইয়ারফোন লাগানো রক্ষী। প্রতিটি মহলে প্রতীক্ষালয়। এক জন নিয়ে গেলেন ফার্স্ট লেডির মহলের অলিন্দ পর্যন্ত, সেখান থেকে অন্য এক জন নিয়ে গেলেন ঘরে। বিরাট ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত ঘর! ‘যত মত তত পথ’-এর প্রবর্তকের ছবি সেই ঘরে, রয়েছে গীতবিতানও।
ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘরোয়া আড্ডায় মা
রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রবেশ দ্বার কতগুলি? ৩৮ নম্বর পর্যন্ত গেট তো চোখে পড়েছে। সংক্ষেপে বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হয়, ভবনটিকে দুর্গই বলা চলা। সঙ্গে অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা। বেসমেন্ট-সহ চার তলা। ভবনের ঠিক মাঝখানে যে গম্বুজ সেটি সাঁচি স্তূপের ধাঁচে তৈরি। ভবনের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে গম্বুজের বাঁয়ে ও ডাইনে দক্ষিণ ও উত্তর উইং। উত্তরে রাষ্ট্রপতির বাস, দক্ষিণে অতিথিশালা। সুইটের নামের কী বৈচিত্র! হিমালয় বেড রুম, গোদাবরী বেড রুম, পেপসু বেড রুম, দ্বারকা বেড রুম...। ভবনে সরকারি দফতরও রয়েছে।
ভবনের রয়েছে কিচেন গার্ডেন। পোষা হরিণ, ময়ূর, খরগোশ। সুইমিং পুল, ক্রিকেট-গল্ফ-পোলো-টেনিসের ব্যবস্থা। বেকারিও। কেক-পেস্ট্রি-বিস্কুট-আইসক্রিম-জ্যাম-জেলি... সব তৈরি হয়। খাবার টেবিলে ন্যাপকিন-সজ্জা এক-এক বেলায় এক-এক রকম। চামচে অশোকস্তম্ভ খোদাই করা! দেওয়ালে-দেওয়ালে ফ্রেসকো, মুরাল, অজস্র ছবি অয়েল, অ্যাক্রেলিক, গ্লাসপেন্টিং... শিল্পীদের মধ্যে অতুল বসু, হুব্বার, সঞ্জয় ভট্টাচার্য... আরও বহু-বহু শিল্পীর সৃষ্টির এই ভাণ্ডার প্রথম দর্শনে মনে হয় ‘হীরামুক্তামাণিক্যের ঘটা/ যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা।” এই ‘হীরামুক্তামাণিক্য’ হল ঐতিহ্য-সংস্কৃতির দ্যুতি। ভবনের কোথাও ধর্মীয় দেবদেবীর ছবি চোখে না-পড়লেও শান্তির প্রতীক বুদ্ধের মূর্তি ও ছবি প্রদর্শিত।
রাষ্ট্রপতি ভবনের নীলম বেড রুম-এ অতিথি হয়ে রাতে শুয়ে মনে হচ্ছিল, এই যে হাজার আলোর ঝাড়বাতি, এত বেলজিয়াম কাচ, এত বহুমূল্য পেন্টিং, দুর্দান্ত সব বই, বর্মা টিকের আসবাব, ওয়াল টু ওয়াল পার্শিয়ান কার্পেট এ সব তো স্বপ্নের মতো! এই অলিন্দ দিয়ে হেঁটে গিয়েছেন লর্ড ও লেডি মাউন্টব্যাটেন, রানি এলিজাবেথ, রাজেন্দ্র প্রসাদ-সহ এই দেশের সব রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রনেতা, দেশবিদেশের বিদগ্ধ মানুষ। রাতের আলো আঁধারিতে মুঘল গার্ডেন্সে ঘুরতে ঘুরতে মনে হল, আলোকস্তম্ভ থেকে বিচ্ছুরিত আলোর সঙ্গে গোলাপের গন্ধের মাখামাখি যে স্বপ্নময়তার সৃষ্টি করছে তা কি সত্য, তা কি মায়া...
না, মায়া নয়। নিখাদ সত্য। ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রতীক এই রাষ্ট্রপতি ভবন। তাঁর স্টাডিতে বসে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি। প্রণব মুখোপাধ্যায়। আলমারি উপচে পড়ছে দেশবিদেশের সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতির বইয়ে। এই সবই তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ! জাতীয় পতাকা রাষ্ট্রপতির মূল আসনের পাশে। রাষ্ট্রপতি ও ফার্স্ট লেডির নিজস্ব বিশ্রামের ঘর থেকে এই ঘরের যে দূরত্ব, তাতে কলকাতা শহরে দু’একটা দুর্গাপুজো হয়ে যায়! তিনি বসেছিলেন সোফায়। হেসে বসতে বললেন। সৌজন্যমূলক আলাপচারিতার শেষে কিছুতেই প্রণাম নিতে রাজি হলেন না রাষ্ট্রপতি। প্রশান্ত হাসি হেসে করজোড়ে বললেন, “গণতন্ত্রে সবাই সমান।”
(২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২, শনিবার, লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়)
ফাইল চিত্র