ভারতের মঙ্গল অভিযানে দিশা দেখাতে পারে গুজরাতের ছোট্ট গ্রাম মাতানোমাধ। — প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
গ্রামের নাম মাতানোমাধ। গুজরাতের কচ্ছ জেলার ভূজ শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ছোট্ট এই গ্রামে খুব কম মানুষের বাস। মাতানোমাধের জীবনযাত্রাও সহজ নয়। কাঁটাঝোপে ঘেরা এই গ্রামের ভূখণ্ড রুক্ষ, ঊষর। মাটি চাষাবাদ তো দূরের কথা, বসতি গড়ে তোলার জন্যও উপযুক্ত নয়। অথচ, মঙ্গল গ্রহে ভারতের ‘মঙ্গলযান-২’ অভিযানের আগে সেই মাতানোমাধই দেখাতে পারে আশার আলো! হয়ে উঠতে পারে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)-র সম্ভাব্য পরীক্ষাকেন্দ্রও।
ঘটনার সূত্রপাত ২০১৬ সালে। মাতানোমাধে আচমকা খোঁজ মেলে এক অদ্ভূতদর্শন পাথরের। গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা জানান, জারোসাইট নামে এই খনিজের বয়স প্রায় সাড়ে ৫ কোটি বছর, যা ভূতাত্ত্বিক সময়রেখা অনুযায়ী প্যালিয়োসিন যুগের সমসাময়িক! এই গবেষণার নেপথ্যে ছিল অহমদাবাদের স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার (এসএসি), পুণের সাবিত্রীবাঈ ফুলে বিশ্ববিদ্যালয় (এসপিপিইউ) এবং লখনউয়ের বীরবল সাহনি ইনস্টিটিউট অফ প্যালিয়োসায়েন্সেসের গবেষকদের একটি দল। মাতানোমাধের বেশ কয়েকটি শিলায় জারোসাইট নামে এই খনিজ পাওয়া যায়। এর থেকে সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়, আজ থেকে লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবী ও মঙ্গল— দুই গ্রহেই একই ধরনের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটেছিল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, গবেষণার স্বার্থে আমরা ধরে নিতে পারি যে কচ্ছের এই গ্রামের সঙ্গে সেই যুগের মঙ্গল গ্রহের পরিবেশগত এবং রাসায়নিক গঠনের মিল ছিল। আর সে কারণেই লাল গ্রহের পৃষ্ঠ, খনিজসম্ভার এবং জৈব-রাসায়নিক গঠন নিয়ে গবেষণার জন্য মাতানোমাধ নিঃসন্দেহে একটি দুর্দান্ত প্রাকৃতিক গবেষণাগার হয়ে উঠতে পারে! অদূর ভবিষ্যতে মাতানোমাধকে বেছে নেওয়া যেতেই পারে রোভার ও অন্যান্য যন্ত্র পরীক্ষা, খননকাজ কিংবা নানা ভূ-রাসায়নিক পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য।
অক্সিজেন, আয়রন, সালফার এবং পটাসিয়াম সমৃদ্ধ কিছু খনিজ পদার্থ জলের উপস্থিতিতে রায়ায়নিক বিক্রিয়া করলে জারোসাইট তৈরি হয়। মঙ্গলে ওই খনিজের উপস্থিতি থেকেও অনুমান করা হয়, লাল গ্রহে কোনও কালে জল ছিল। এর আগে মেক্সিকো, কানাডা, জাপান, স্পেন এবং মার্কিন মুলুকের উটা এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় একই রকমের জারোসাইট পাওয়া গিয়েছে। ২০১৬ সালে স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারের এক দল গবেষক প্রথম গুজরাতের কচ্ছে জারোসাইটের উপস্থিতি টের পান। প্রায় একই সময়ে কেরলের ভারকালা পাহাড়েও এই খনিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু মাতানোমাধ ঘন জনবসতিপূর্ণ নয়, তাই একেই মঙ্গলগ্রহ বিষয়ক পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য তুলনামূলক ভাবে বেশি উপযুক্ত বলে মনে করছেন গবেষকেরা। ভারতের ভবিষ্যতের মঙ্গলযান অভিযানের আগে নানা গবেষণার জন্য এই গ্রামকে বেছে নিতে পারে ইসরোও।
নতুন এই গবেষণার ফলাফল গত মাসে জিয়োলজিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। পুণের সাবিত্রীবাঈ ফুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের প্রধান গবেষক আদিত্য ধরাইয়া সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘‘আমাদের গবেষণা একদিকে যেমন পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক অতীতকে মঙ্গলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে, তেমনই জ্যোতির্বিজ্ঞান (প্রাণিজগত, গ্রহ ও নক্ষত্রের উৎপত্তি এবং বিবর্তন), খনিজতত্ত্ব এবং ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের জন্য একটি প্রাকৃতিক নীলনকশাও এঁকে দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’’