নীতি প্রশ্নে নীতীশ। ফাইল চিত্র
রাজনীতিতে ক্ষমতাই আসল? না কি নীতি?
এ দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বার বারই এ প্রশ্ন উঠেছে। জবাবও ‘ডিম আগে, না মুরগি’র মতো অমীমাংসিত থেকে গিয়েছে। সেই চর্চায় নিজের নাম জুড়লেন নীতীশ কুমার। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে বুধবার ইস্তফা দিয়ে বৃহস্পতিবার ফের তিনি সেই পদে শপথ নিলেন। শুধু বদলে নিলেন জোট সঙ্গী। নীতীশের দাবি, দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করতে পারছিলেন না বলেই এই সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন- রাজ্যপালের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার ভাবনা লালুর
নীতীশের এই ‘নীতিনিষ্ঠতা’কে দু’হাত তুলে অভিবাদন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অথচ এই মোদীকেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরার পরেই নীতির প্রশ্ন তুলে ২০১৩-র ১৬ জুন এনডিএ ছেড়েছিলেন নীতীশ। ফের সেই ‘বন্ধু’র হাত ধরায় প্রশ্নটা উঠছে, সত্যিই কি নীতির প্রশ্ন, নাকি ক্ষমতার নাগরদোলায় নিজের ব্যালান্সটা ঠিকঠাক রাখা?
ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ যেমন নীতীশকে সরাসরি ‘ক্ষমতালোভী’ বলেছেন। এ দিন সকালে রামচন্দ্র টুইটারে লেখেন, “রাজ্যপালকে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার আর্জিই জানানো উচিত ছিল নীতীশ কুমারের। নীতীশ বলছেন, লালুপ্রসাদ পয়সালোভী, তিনি তো আসলে ক্ষমতার লোভটা দেখিয়ে ফেললেন।” সঙ্গে রামচন্দ্রের সংযোজন, বিজেপি-র সঙ্গে ফের জোট বাধার আগে বিহারবাসীর মত জানতে নীতীশের নতুন করে ভোটে যাওয়া উচিত ছিল।
লালুপ্রসাদ ঘনিষ্ঠ তথা আরজেডির মুখপাত্র মনোজ ঝা তো এক ধাপ উপরে উঠে নীতীশকে এ দিন ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিহারের জনমত বিজেপি-র বিরুদ্ধে ছিল। নীতীশ সেই জনমতকে উপেক্ষা করে পুরনো সঙ্গীর হাত ধরেছেন। আগামী নির্বাচনে মানুষ এর জবাব দেবে।’’ তাঁর দলের সুপ্রিমো ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন বলে জানিয়েছেন। অভিযোগ, রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী পক্ষপাতিত্ব করেছেন। বিধানসভায় সর্বাধিক বিধায়ক লালুপ্রসাদের দলের। তা হলে ফের সরকার গড়তে কেন নীতীশকেই ডাকা হল? প্রশ্ন লালুর।
আরও পড়ুন- রাতারাতি ‘বন্ধু’বদল করে ফের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ
এ সবকে যদিও পাত্তাই দিচ্ছেন না নয়া মুখ্যমন্ত্রী। শপথ নিয়েই তিনি টুইট করেছেন, “প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। দুর্নীতির সঙ্গে কোনও আপোস নয়। কেন্দ্রের সহযোগিতায় রাজ্যের উন্নয়নে গতি আসবে।”
এই ‘গতি’ শব্দেই জোর দিচ্ছেন জেডিইউ বিধায়ক শ্যামবাহাদুর সিংহ। তাঁর দাবি, নীতীশ বিহারের জনগণকে চেনেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, মানুষ বিরক্ত। কেননা, গত ২০ মাসে রাজ্যে উন্নয়নের গতি একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। ওই নেতার কথায়, ‘‘বিজেপি-র সঙ্গে কাজ করতে নীতীশ অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। রাজ্যের উন্নয়নে ফের গতি আনবেন তিনি।’’ একই সুর বিজেপি নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী নন্দকিশোর যাদবের মুখেও। তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, ‘‘নীতীশ আমাদের স্বাভাবিক জোটসঙ্গী। এতে রাজ্যেরই উপকার হবে।’’
রামচন্দ্র গুহর টুইট...
বিহারবাসীর একটা বড় অংশ নীতীশের এই বিজেপি-প্রীতিকে সমর্থন করছেন। তাঁদের মতে, এর আগের দফায় নীতীশ-প্রশাসন ভাল করেছে। রাজ্যে আইনের শাসন ছিল। কিন্তু, গত ২০ মাসে কোথাও একটা গণ্ডগোল টের পাচ্ছিলেন তাঁরা। নালন্দার বাসিন্দা কুঞ্জলাল মাহাতোর কথায়, ‘‘নীতীশ কুমারের আগের দফায় আরজেডি নেতাদের দাপট প্রায় দেখাই যেত না। কিন্তু, গত কয়েক মাস ধরে সেই নেতাদেরই ভোল পাল্টে গিয়েছে। অত্যাচার বেড়েছে। এ বার হয়তো তা কমবে।’’ একই কথা বলছেন আরার বিনোদবিহারী তিওয়ারি। তিনি বললেন, ‘‘এই দফায় রাজ্যে কোনও বড় প্রোজেক্ট হয়নি। বিভিন্ন দফতরে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দফতরের কথা তো বলার মতো নয়। গত ২০ মাসে বিহার ২০ বছর পিছিয়ে গিয়েছে।’’
রামচন্দ্র গুহর টুইট...
বিজেপি-র সঙ্গে নীতীশের সম্পর্ক সেই ১৯৯৬ থেকে। এর পর ২০১৩ পর্যন্ত তা অটুট ছিল। এর পরের চার বছর লালুপ্রসাদই ছিলেন নীতীশের ‘বন্ধু’। সেই সম্পর্কে এ বার চোট লাগল। বিহারবাসীর একটা অংশের মতে, আসলে নীতীশ শুধু রাজ্যে উন্নয়নের কথা ভাবেননি। তাঁর চোখ আসলে ২০১৯-এর লোকসভা এবং ২০২০-র বিধানসভা নির্বাচনেই। তিনি বুঝতে পারছিলেন, কেন্দ্রের সঙ্গে লড়াই করে রাজ্যে উন্নয়ন সম্ভব নয়। পাশাপাশি, জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী রাজনীতির অবস্থা যে বেশ কোণঠাসা, সেটাও টের পাচ্ছিলেন নীতীশ। সেখানে তাঁর অবস্থানও অনেকটা পিছনের সারিতে। কিছুটা সেই অবস্থানে বদল আনতে এবং আগামী লোকসভা নির্বাচনে সংসদে বেশি সংখ্যায় জেডিইউ সদস্যকে পৌঁছে দিতে চান নীতীশ। আবার, লালুর সঙ্গে জোট করে বিধানসভায় ফের ক্ষমতায় ফিরে আসার ব্যাপারেও তিনি খুব একটা আশাবাদী নন। বিজেপি-র হাত ধরলে এর সব ক’টাই সম্ভব বলে নীতীশ মনে করেছেন। ওই অংশের মত এমনটাই।
তবে, দিনের শেষে নীতীশ কুমারকে সেরা খোঁচাটা বোধহয় দিয়েছেন লালুপ্রসাদ যাদব। নীতীশের বিরোধী শিবির চিরকালই তাঁর সম্পর্কে একটা কথা বলেন, ‘অ্যায়সা কোই সগা নেহি, জিসকো নীতীশনে ঠগা নেহি’। বাংলায় যার মানে, এমন কোনও আত্মীয় নেই, যাঁকে নীতীশ ঠকাননি।
এ দিন সদ্য ‘বন্ধু’হারা লালুপ্রসাদ ফের এই বাক্যেই বিঁধেছেন নীতীশকে।