পাড়ায় পাড়ায় মাটির ভাঁড় ঝুলিয়ে দিয়েছে অমদাবাদ, থমথমে মুসলিম মহল্লা

উন্নয়নের ধুলো উড়িয়ে দ্রুতগামী ট্রাক গুজরাতের এই তেলখাওয়া রাস্তায় ক্রমশ গতি বাড়াচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে বড় বেমানান অমদাবাদ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরেই পাঁচতারা হাইওয়ের সামান্য দূরে বর্জ্যের এই পাহাড়টি।

Advertisement

অগ্নি রায়

জুহাপুরা শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৭ ০২:১৬
Share:

গুজরাতের জুহাপুরায় ব্যস্ত সন্ধ্যা। নিজস্ব চিত্র।

হেমা মালিনির গালের মসৃণতার সঙ্গে বিহারের রাস্তার তুলনা করে এক সময়ে বিতর্ক বাধিয়েছিলেন সে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ।

Advertisement

উপমাটি নিশ্চয়ই মোক্ষম ছিল! না হলে মুম্বইগামী অমদাবাদ-বডোদরা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এত দিন পর যেতে যেতে কেন মনে পড়বে সে কথা!

উন্নয়নের ধুলো উড়িয়ে দ্রুতগামী ট্রাক গুজরাতের এই তেলখাওয়া রাস্তায় ক্রমশ গতি বাড়াচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গে বড় বেমানান অমদাবাদ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরেই পাঁচতারা হাইওয়ের সামান্য দূরে বর্জ্যের এই পাহাড়টি। উচ্চতায় ধাপার থেকেও বেশি। এটিই হিরানা ওয়েস্ট ডাম্পিং গ্রাউন্ড। যার ঠিক পিছনে দাঙ্গাপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুনর্বাসন কেন্দ্র। মাছি ভনভন এক বসতি, জনতা কলোনি। যার পাশেই তুলনায় পরিচ্ছন্ন এক মুসলমান পাড়া, জুহাপুরা। ১৯৬০ সালের সাম্প্রদায়িক হিংসার সময়ে পুরনো অমদাবাদ থেকে মুসলিমদের একটা বড় অংশ এখানে এসে ডেরা বেঁধেছিলেন।

Advertisement

ভোটের মুখে এখন এই মহল্লাগুলিতে হয়তো গোধরা-কাণ্ডের সেই আতঙ্ক আর নেই। কিন্তু রয়েছে অনিশ্চয়তা ও অস্তিত্বের সঙ্কট। দ্বিধা আর তীব্র বিষাদ।

“আপনি তো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাবরমতী নদীর পশ্চিম আর পূর্ব প্রান্তের তফাতটা কি চোখে পড়েছে?” প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন সুফি আনসার হুসেন শেখ। স্থানীয় মাদ্রাসার এই শিক্ষকটিকে জানালাম, হ্যাঁ পড়েছে বৈকি। পশ্চিম প্রান্তে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’। ঝকঝকে প্লাজা। ড্রাইভ-ইন অ্যাম্ফিথিয়েটার। উজ্জ্বল আবাসন। আধুনিক রেস্তোরাঁ। চওড়া রাস্তা।

আর পূর্বে? গাড়ি ঢোকা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে, এতটাই ঘিঞ্জি। এক দিকে ভদ্রা ফোর্ট, অন্য দিকে জীর্ণ তিন দরওয়াজার মাঝে কয়েক হাজার রাস্তার ভেন্ডার। কাবাবের গন্ধ ছাড়া বিজ্ঞাপিত হওয়ার আর কিছু নেই!

পরের প্রশ্ন আনসারের। “পশ্চিম অমদাবাদের কলোনিগুলিতে মাটির ভাঁড় ঝোলানো দেখেছেন? জানেন তার মানে কী?”

স্বীকার করতেই হল দেখেছি, কিন্তু তাৎপর্য তো জানি না। পরে আনসার হুসেন শেখ শুধু নয়, হিন্দু সমাজের অনেকের কাছে যেটা জানা গেল, ওই ‘মাটরি’ ঝুলিয়ে দেওয়ার অর্থ, লক্ষ্ণণরেখা! অন্য কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বাড়িঘর ভাড়া বা বিক্রি না করার প্রতীকি ঘোষণা হিন্দুদের।

পাতিদারদের জন্য লড়ছেন হার্দিক। রাহুল গাঁধীর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কিন্তু এ বারের প্রচারে রাহুল গোধরার নামোচ্চারণও করছেন না। জুহাপুরাতেই একটি মাঝারি মাপের আসবাবের দোকান চালান গিয়াসুদ্দিন আনসারি। বয়সের জ্যামিতি মুখে আঁকা। ধীর কণ্ঠে বললেন, “২০০৭-এ মোদীকে মওত কা সওদাগর বলেছিলেন সনিয়া গাঁধী। যা ব্যুমেরাং হয়ে হিন্দু ভোটকে জাগিয়ে দেয়। জয়জয়কার হয় মোদীর। এ বারে রাহুল আসছেন, সমস্ত মন্দিরে ঘুরছেন। কিন্তু আমাদের কথা কে ভাববে?”

পাশে বসা আর এক ব্যবসায়ী আনোয়ার হুসেন শেখের গলাতেও ক্ষোভ। বলছেন, “ওদের খাম-এর কৌশল এখন বদলে গিয়ে হয়েছে খাপ!” ‘খাম’— অর্থাৎ ১৯৮০ সালে কংগ্রেসের তৈরি সামাজিক জোট, যার শরিক ছিলেন ক্ষত্রিয়, হরিজন, আদিবাসী এবং মুসলিম। জুহাপুরার আক্ষেপ, এখন মুসলিমের জায়গা নিয়েছে পাতিদার।

১৯৮০-তে গুজরাত বিধানসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্ব ছিল ১২। এখন টিমটিম করছে দুইয়ে। বিজেপিকে ভোট দেওয়ার প্রশ্ন নেই। কিন্তু কংগ্রেসের বাক্সে ফের ভোট দেওয়ার আগে মুসলিম মনের অভিমানটা কিন্তু আড়ালে থাকছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন