মন্তব্যে রাজনীতির গন্ধ, বিতর্কে সেনাপ্রধান

প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সেনার হস্তক্ষেপের নজির রয়েছে ভূরি ভূরি। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি সেই পথেই এগোবে নরেন্দ্র মোদীর ভারত?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা 

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:২০
Share:

নয়াদিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে বিপিন রাওয়ত। বৃহস্পতিবার। পিটিআই

গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কাঠগড়ায় তুলে বিতর্কে জড়ালেন সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়ত।

Advertisement

গত এক মাস ধরে নয়া নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে দেশ জুড়ে চলা বিক্ষোভের আবহে আজ দিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে নেতৃত্বের ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন রাওয়ত। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘আমরা দেখছি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা বহু মানুষের ভিড়কে নেতৃত্ব দিয়ে শহরে অগ্নিসংযোগ ও হিংসা ছড়াচ্ছেন। এটা কখনওই নেতৃত্ব হতে পারে না। যারা মানুষকে ভুল পথে চালিত করে, তারা কখনওই নেতা নয়।’’ এর পরেই নেতার সংজ্ঞা দিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘‘এক জন নেতা হলেন তিনি, যিনি আপনাকে ঠিক অভিমুখে চালনা করবেন, আপনাকে ঠিক পরামর্শ দেবেন এবং আপনার আশেপাশের মানুষদের খেয়াল রাখবেন।’’

প্রতিবেশী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সেনার হস্তক্ষেপের নজির রয়েছে ভূরি ভূরি। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি সেই পথেই এগোবে নরেন্দ্র মোদীর ভারত? আগামী ৩১ ডিসেম্বর সেনাপ্রধান পদ থেকে অবসর নিচ্ছেন রাওয়ত। সদ্য তৈরি হওয়া তিন বাহিনীর প্রধান হিসেবে ‘চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ’ পদের জন্য তাঁর নাম ভাবা হচ্ছে। ওই পদের দৌড়ে রয়েছেন নর্দার্ন আর্মি কম্যান্ডার রণবীর সিংহও। বিরোধীদের বক্তব্য, এমন এক সময়ে কেন্দ্রকে ইতিবাচক বার্তা দিতেই কি গণআন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন সেনাপ্রধান?

Advertisement

প্রাক্তন সেনানীদের মতে, এ ভাবে কমর্রত অবস্থায় রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে মুখ খুলে নিয়ম ভেঙেছেন রাওয়ত। প্রাক্তন সেনাপ্রধান শঙ্কর রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘গোটা বিষয়টি ঠিক জানি না। এক জন নেতার সংজ্ঞা হিসেবে সেনাপ্রধান ঠিক কথাই বলেছেন। আবার সেনা আইনে কর্মরত অবস্থায় রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করা যায় না।’’ প্রাক্তন নৌসেনা প্রধান এল রামদাস অবশ্য সরাসরি বলছেন, ‘‘অনুচিত মন্তব্য। আইনে বলা আছে, সেনা কোনও রাজনৈতিক দলের নয়, দেশের সেবায় নিয়োজিত। আজ এক জন সেনার মুখ থেকে যে কথা শুনলাম, তা অন্যায়। তা তিনি সেনা কর্তাই হোন বা নিম্নপদস্থ কর্মী।’’

আরও পড়ুন: ‘দেড় লাখি’ চশমা বিতর্কে ‘ফকির’

সেনাবাহিনীর আইনে বলা রয়েছে, কর্মরত অবস্থায় বাহিনীর কোনও সদস্য কোনও রাজনৈতিক সভায় অংশ নিতে পারবেন না। কোনও ধর্না-বিক্ষোভে যোগ দেওয়ারও অধিকার তাঁর নেই। সংবাদমাধ্যমে বা কোনও বইয়েও রাজনৈতিক মতামত দিতে পারবেন না তিনি। তাই প্রাক্তন মেজর জেনারেল এস ভমবাদকেরেলও বলছেন, ‘‘সেনাপ্রধান যা বলেছেন, তা অনুচিত।’’

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাধীনতার পর থেকেই খুব সতর্ক ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হয়েছে যাতে সেনা কখনওই এ দেশের গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে না-পারে। ভারতের সংবিধানও রচিত হয়েছে সেই বিষয়টি মাথায় রেখে। যেখানে সংসদ ও বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থান অনেক উঁচুতে। সেই কারণে প্রতিবেশী বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে একাধিক সেনা অভ্যুত্থান হওয়া সত্ত্বেও ভারতে তার কোনও আঁচ পড়েনি। এ দেশের সেনা বরাবরই নিজেদের অরাজনৈতিক চরিত্র বজায় রেখে ৭২ বছর পেরিয়ে এসেছে। রাওয়তের মন্তব্য প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দী বলেন, ‘‘এই ধরনের প্রবণতা সম্ভবত এই দেশে প্রথম। অতীতে কোনও সেনাপ্রধানকে এ ভাবে রাজনৈতিক মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। সম্ভবত সরকার সেনাপ্রধানকে ওই কথা বলার জন্য শিখিয়ে দিয়েছে।’’ বিরোধী শিবিরও বলছে, রাওয়তের মন্তব্য যথেষ্ট উদ্বেগজনক। সংবিধান শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে মান্যতা দেয়। যে ভাবে সেনাপ্রধান গণআন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাতে অশনি সঙ্কেত দেখছেন কংগ্রেস নেতা ব্রিজেশ কালাপ্পা। তাঁর আশঙ্কা, ‘‘আজ যদি সেনাপ্রধান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মতামত দেন, তা হলে তো ভবিষ্যতে দখলদারির অধিকার জন্মাবে সেনার।’’ স্বরাজ ইন্ডিয়া দলের নেতা যোগেন্দ্র যাদব সেনাপ্রধানের কথার সূত্রেই নিশানা করেছেন মোদীকে। বলেছেন, ‘‘সেনাপ্রধান ঠিক বলেছেন। নেতার উচিত জনতাকে ঠিক অভিমুখে চালনা করা। আমি নিশ্চিত তিনি যখন ওই কথা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কথা ভেবেই বলেছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন