অসমে বদলের দিন গগৈয়ের দুর্গ ভেঙে নায়ক ভারোত্তলক

বছর পাঁচেক আগে অসম গণ পরিষদ ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন বিজেপিতে। পরের বছরই দলের প্রদেশ সভাপতি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে রাজ্যে বিজেপিকে সফল ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে মেলে আশাতীত সাফল্য। কেন্দ্রে মন্ত্রী হন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৬ ০২:৫৬
Share:

অসমে জয়ার পর। মাজুলির গনণাকেন্দ্রে সর্বানন্দ সোনোয়াল। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।

বছর পাঁচেক আগে অসম গণ পরিষদ ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন বিজেপিতে। পরের বছরই দলের প্রদেশ সভাপতি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে রাজ্যে বিজেপিকে সফল ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে মেলে আশাতীত সাফল্য। কেন্দ্রে মন্ত্রী হন। ২০১৬ সালে ফের দল তাঁকে প্রদেশের দায়িত্বে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বিজেপির মোদী-শাহ জুটির চলতি প্রথা ভেঙেই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে দল। এবং একদা ‘ভারোত্তলক’ কার্যত কাঁধে করেই দলকে নিয়ে এলেন অসমে ক্ষমতার মসনদে। নিজেও বসতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে।

Advertisement

তিনি সর্বানন্দ সোনোয়াল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর নামে স্লোগান তুলে দিয়ে গিয়েছেন— অসম কি আনন্দ/সর্বানন্দ। আর সাধারণ অসমবাসীর কাছে তো তাঁর পরিচয় ‘সর্বা’ হিসেবেই।

সর্বানন্দের গত পাঁচ বছরের রাজনৈতিক জীবনের এই ‘ঊর্ধ্বমুখী লেখচিত্র’ যে কোনও রাজনৈতিক নেতার কাছেই ঈর্ষণীয়। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯— টানা সাত বছর আসুর সভাপতি ছিলেন সর্বানন্দ। গোটা ভারতে যখন বিদেশি শণাক্তকরণে ফরেনার্স অ্যাক্ট চালু, তখন অসমে চালু ছিল আইএমডিটি আইন। তাতে বিদেশি সন্দেহে কাউকে ধরলে তাকে বিদেশি হিসেবে প্রমাণ করার দায়িত্ব ছিল পুলিশেরই। এই আইনের বিরোধিতা করে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সর্বানন্দ। আইনি লড়াইয়ের পরে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশকে ‘বহিরাগত আগ্রাসন’ হিসেবে মেনে নেয় উচ্চতম আদালত। বাতিল হয় আইএমডিটি আইন। বলা হয়, নিজেদের ভারতীয় হিসেবে প্রমাণ করতে হবে ধৃতদেরই। এই জয়ের পর আসু সর্বানন্দকে জাতীয় নায়কের খেতাব দেয়। ২০০১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত মরাণের অগপ বিধায়কও ছিলেন সর্বা। ২০০৪ সালে তিনি ডিব্রুগড় থেকে অগপ টিকিটে সাংসদও হন।

Advertisement

আসলে নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতায় বিজেপির প্রবীণ নেতাদেরও ছাপিয়ে যান সর্বানন্দ। যে কারণে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা তিন-চারবারের সাংসদ বিজয়া চক্রবর্তী, রমেন ডেকা বা রাজেন গোঁহাইদের বাদ দিয়ে বেছে নেন সর্বাকেই। ১৯৬২ সালে তাঁর জন্ম। বয়স ৫৪। একেবারে তরুণ না হলেও অসমের এই প্রাক্তন ছাত্রনেতার উপরেই ভরসা রেখেছিলেন মোদী-শাহ জুটি। তাঁদের হতাশ করেননি সর্বা।

১৯৮৫ সালে অসমে বিজেপির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ক্ষমতা দখলে লাগল ৩১টি বছর। সবই ছিল, ছিল না যোগ্য নেতা। এত দিন রাজ্যে পরজীবীর মতো ধুঁকছিল বিজেপি, সর্বানন্দের হাতে পড়ে সেই দলই দু’বছরের মধ্যে লোকসভায় ১৪টির মধ্যে সাতটি আসন ছিনিয়ে নেয়। বিজেপির দায়িত্ব নেওয়ার চার বছরের মধ্যেই দিসপুর দখল করলেন তিনি। জানিয়ে দিলেন, এত দিন বিকল্প ছিল না, তাই গগৈ সরকার চলছিল। এখন গগৈয়ের বিকল্প এসে গিয়েছে।

বিধানসভার লড়াইয়ে সর্বাকে বাড়তি শক্তি জুগিয়েছেন অবশ্যই তাঁর এক সময়ের সহকর্মী ও পরবর্তী কালের কড়া প্রতিদ্বন্দ্বী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। সর্বার সঙ্গে হিমন্তের জোটবন্ধন বিজেপিকে বাড়তি গতি, বাড়তি প্রাণশক্তি নিঃসন্দেহে জুগিয়েছে। সর্বা-হিমন্তের যৌথ উদ্যমই বিজেপির সঙ্গে জোটে টেনে এনেছে তাঁদের পুরনো দল অসম গণ পরিষদকে। তাঁরা টেনে এনেছেন বড়ো পিপল্স ফ্রন্টের চেয়ারম্যান হাগ্রামা মহিলারিকে। সব মিলিয়ে সর্বার দূরদর্শিতা ও হিমন্তের প্রতিশোধস্পৃহা প্রায়-নব্বইয়ের তরুণ গগৈয়ের চতুর্থ বার ক্ষমতায় বসার স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়েছে।

অকৃতদার সর্বানন্দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। সদাহাস্যমুখ সর্বানন্দ সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। একই সঙ্গে ক্ষুরধার বুদ্ধিতে চালিয়ে গিয়েছেন জমি দখলের লড়াই। তার সঙ্গে ছিল রাজ্য জুড়ে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া।

তবে তাঁর পথ যে খুব মসৃণ ছিল না তা স্বীকার করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও। তিনটি প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে তাঁকে এগোতে হয়েছে। লোকসভা ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রাজ্য থেকে সব বাংলাদেশিকে তাড়ানো হবে। রাজ্যের জমি বাংলাদেশকে দেওয়া হবে না। বৃহৎ নদীবাঁধ গড়তে দেবে না বিজেপি। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তিনটি ক্ষেত্রেই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরতে বাধ্য হন বিজেপি নেতৃত্ব। প্রতিশ্রুতিভঙ্গের দায়ে বিজেপিকে কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা করে কংগ্রেস। লাভ যে হয়নি তার প্রমাণ তো ফলেই মিলেছে।

তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ক্ষমতা দখলের লড়াই জিতলেও, এ বার ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইটাও সর্বার পক্ষে খুব সহজ হবে না। উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত হবেন নাকি অগপ সভাপতি অতুল বরা, কিংবা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্ত— তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে। মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাওয়া নিয়েও অনেক কঠিন অঙ্ক সামলাতে হবে তাঁকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন