‘ভোট তো দেব তারপর? গণতন্ত্রের চেয়ে জীবন দামি’

আপনাদের মনে আছে কি না জানি না, ওই ছবিতে ছোট্ট ভূমিকায় আমিও ছিলাম। বাস্তব জীবনে যে কাজ আমি করি, সেই কাজ করতেই আমাকে দেখা গিয়েছিল পর্দাতেও। সাংবাদিকতা। সেই কাজের সূত্রে বেরিয়েই ছবিটা বড় প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছিল।

Advertisement

মঙ্গল কুঞ্জম (দন্তেওয়াড়ার সাংবাদিক)

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:৩৪
Share:

নিউটন ছবির একটি দৃশ্যে মঙ্গল (ডান দিকে)।

সিনেমা বাস্তব নয়। কিন্তু সিনেমাকেই কখনও কখনও মনে হয় যেন অনেক বেশি বাস্তব।

Advertisement

অনেকটা তেমনই মনে হচ্ছিল সোমবারও। সকালেই ভোট কভার করতে বেরিয়েছি। মাওবাদীদের গড় বলে পরিচিত দন্তেওয়াড়া বিধানসভার নানা এলাকায় ঘুরছি। মাওবাদী আতঙ্ক ভুলিয়ে ভোটারদের ভোটমুখী করতে আপ্রাণ সচেষ্ট প্রশাসন। ভোটকেন্দ্র যেন যুদ্ধক্ষেত্র! আশপাশে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সতর্ক জওয়ানেরা। ঠিক ‘নিউটন’ ফিল্মের মতো।

আপনাদের মনে আছে কি না জানি না, ওই ছবিতে ছোট্ট ভূমিকায় আমিও ছিলাম। বাস্তব জীবনে যে কাজ আমি করি, সেই কাজ করতেই আমাকে দেখা গিয়েছিল পর্দাতেও। সাংবাদিকতা। সেই কাজের সূত্রে বেরিয়েই ছবিটা বড় প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছিল।

Advertisement

এ বারে ভোটের আগেই মাওবাদী হানার ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ গিয়েছে জওয়ানদের, এমনকি, এক সংবাদকর্মীরও। ভোটের দিনও জওয়ানদের সঙ্গে মাওবাদীদের গুলি-বিনিময় হয়েছে। তার পরেও অনেকে ভয়কে জয় করে ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। যত শতাংশ মানুষ ভোট দেবেন সেই পরিসংখ্যান নিয়ে গণতন্ত্রের সাফল্যের বিচার হবে। ‘নিউটনে’ও আপনারা দেখেছেন ভোট শুরু হওয়ার পরে মিডিয়াকে এনে প্রশাসনের কর্তারা দাবি করছিলেন, গণতন্ত্র সফল। ভোট যত শতাংশই পড়ুক, বাস্তবে কতটা সফল গণতন্ত্র, কতটা সফল প্রশাসন?

আরও পড়ুন: পিঙ্ক বুথ নির্বিঘ্নে ভোট করিয়ে খুশি বাঙালি শিক্ষিকা

আমার গ্রাম গুমিয়াপাল। সেখানকার কেউই এ বার ভোট দেননি। আমি নিজেও ভোট দিইনি। দিয়েছিলাম গত বার। তার পর আমাকে নানা অসুবিধের মুখে পড়তে হয়। স্বীকার করতে হয়, ভোট দিয়ে ভুল করেছি। তাই এ বার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভোট দেব না। শুধু গুমিয়াপাল কেন, হিরোলি, সমলবার, কুটরেম, তনেলি, পেড়কা, অলনার এমন নানা গ্রামে বহু মানুষ ভোট দেননি। কোনও গ্রামের পাঁচশো জনের মধ্যে দু’জন ভোট দিয়েছেন। কোনও গ্রামের হাজার জনের মধ্যে পাঁচ জন ভোট দিয়েছেন। তবে এই ছিটেফোঁটা ভোটও মোট ভোটে যোগ হয়ে শতাংশের ভগ্নাংশ বাড়াবে। তাতে কী লাভ? ভোট গণতন্ত্র উদ্‌যাপনের উৎসব। আর তাতে শামিল হতে যেতে হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্রের পাহারায়!

গ্রামবাসীরাও নিরুপায় প্রশাসন আর মাওবাদীদের লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে। এখন না হয় এক লক্ষ জওয়ান এনে ভোটের আয়োজন হয়েছে। কিন্তু সেই এক লক্ষ জওয়ান কত দিন থাকবেন? কিন্তু গ্রামবাসীরা ওই এলাকার জল-জঙ্গল-জমি নিয়ে বেঁচে থাকেন। তাঁদের সারা বছর ওখানেই বাঁচতে হবে। মাওবাদীদের নির্দেশ অমান্য করে ভোট দিলে ভোট মিটে যাওয়ার পর তাঁদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তো নিজেদেরই নিতে হবে। তাই তাঁদের কাছে গণতন্ত্রের চেয়ে নিজের জীবনের দাম বেশি।

আরও পড়ুন: ভোটের আগে মাথাপিছু টাকা ঢেলেছে বিজেপি! রাতে তাই বেদম নাচ আর মাংস-ভাত

‘নিউটন’ ছবিতে আমার চরিত্র পুলিশকর্তাকে একটা প্রশ্ন করেছিল। তা ছিল, ‘আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীরাই আবার মাওবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ছে, এর পিছনে কী যুক্তি’। সেই প্রশ্ন আবার মনে পড়ছে। এই যে এত হিংসা, সেনা মারা যাচ্ছে, মাওবাদীর মৃত্যু হচ্ছে, সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, এ তো ভাই ভাইকে মারছে। এই সমস্যা তো আপনাদের বাংলাও দেখেছে, তেলঙ্গানা দেখেছে। এটা কোনও বিশেষ দলের ব্যাপার নয়। এটা ব্যবস্থার গলদ। এই মৃত্যু কেন হবে? এই প্রশ্নগুলো আমি করতে চাই। মাওবাদীরা তো গণতন্ত্রে বিশ্বাসই করে না। তাই ওদের প্রশ্ন করতে চাই না। প্রশ্নগুলো করতে চাই যাঁরা গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্বে আছেন, সরকারে আছেন তাঁদের।

সিনেমা শেষ হয়ে যায় দু’-তিন ঘণ্টায়। ভোটও একদিনে মিটে যায়। গাঁয়ের মানুষদের সারা বছর বাঁচতে হয়। সেটা ঘোর বাস্তব। সিনেমা নয়।

(অনুলিখন সুজিষ্ণু মাহাতো)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন