Assembly Elections 2018

ত্রাহি মধুসূদন বলে এ বার সঙ্ঘের দ্বারস্থ বিদ্রোহে জেরবার শিবরাজ

মধ্যপ্রদেশের তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান। নিঃসন্দেহে জনপ্রিয়ও। কিন্তু ভোটের টিকিট বিলির প্রক্রিয়ায় যে রকম একতরফা খেলাটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, তার জেরে নিজেই স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না আর।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

ভোপাল শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৮ ১২:৫০
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আরএসএস বলেছিল, ৮৫ জন বিধায়ককে এ বার টিকিট না দিতে। তিনি শোনেননি। সুমিত্রা মহাজনের মতো হেভিওয়েট নেত্রী চেয়েছিলেন, ছেলে টিকিট পান। তিনি হতে দেননি।কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের মতো জনপ্রিয় মহারথী চেয়েছিলেন, নিজের ছেড়ে যাওয়া মহু আসনে ছেলে আকাশকে টিকিট দেওয়া হোক। তিনি আসন বদলে দিয়েছেন। সত্তরোর্ধ্ব নেতাদের অনেকেই চেয়েছিলেন এ বারও লড়তে, অথবা পরিবারের কাউকে টিকিট পাইয়ে দিতে। তিনি সে আশায় জল ঢেলে দিয়েছেন।

Advertisement

তিনি শিবরাজ সিংহ চৌহানমধ্যপ্রদেশের তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী। নিঃসন্দেহে জনপ্রিয়ও। কিন্তু ভোটের টিকিট বিলির প্রক্রিয়ায় যে রকম একতরফা খেলাটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, তার জেরে নিজেই স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না আর। মধ্যরাতে আরএসএস দফতরে গিয়ে বৈঠক করতে হয়েছে। অন্তত ৬০টা আসনের জন্য আরএসএসের কাছে প্রায় করজোড়ে সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়েছে।

মধ্যপ্রদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই সঙ্ঘের শিকড় অত্যন্ত গভীরে। দেশের মধ্যভাগের এই রাজ্যে বিজেপির প্রতিটা জয়ের নেপথ্যে সঙ্ঘের যথেষ্ট অবদান। তবে ১৩ বছর ধরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকা শিবরাজ সিংহ চৌহান সম্ভবত একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন এ বার। তাই সঙ্ঘের তোয়াক্কা খুব বেশি করছিলেন না। ভোট কাছে আসার অনেকটা আগেই সঙ্ঘের তরফে বিজেপি-কে জানানো হয়েছিল, অন্তত ৮৫ জন বিধায়ককে এ বার টিকিট দেওয়া উচিত হবে না। একেবারে মাটি থেকে আসা প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতেই ওই বিধায়কদের তালিকা তৈরি করেছিল সঙ্ঘ। কিন্তু শিবরাজ সে কথা কানে তোলেননি।

Advertisement

সমিধায় সঙ্ঘের দফতরে শিবরাজ সিংহ চৌহান।

আরও পড়ুন: পাঁচ বছরে ঢেলেছেন ১৮৫ কোটি! তবু কেশপুর-গড়বেতার ছায়া মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রে​

বয়সের কারণে কিছু বিধায়ককে আর টিকিট দেওয়া হয়নি বিজেপির নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই। কিছু বিধায়ক টিকিট পাননি সঙ্ঘের দেওয়া ‘ফিডব্যাক’ মেনে। কিন্তু সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৫৪। ফলে যাঁদের টিকিট দেওয়া নিয়ে সঙ্ঘের আপত্তি ছিল, তাঁদের অধিকাংশই এ বার বিজেপির টিকিটে লড়ছেন। স্বাভাবিক কারণেই অনেক এলাকায় সঙ্ঘের লোকজন ভোটের কাজ থেকে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেদের।

আরএসএস-এর এই ঈষৎ নিস্পৃহ আচরণ নিয়ে প্রথমে খুব একটা চিন্তায় ছিলেন না শিবরাজ। কিন্তু টিকিট বণ্টন সংক্রান্ত অসন্তোষের জেরে বিজেপির চেনা শৃঙ্খলা এ বার গায়েব। আর উল্টো দিকে কংগ্রেসের তিন প্রধান মুখ কমলনাথ, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া এবং দিগ্বিজয় সিংহ অভূতপূর্ব ঐক্যের ছবি তুলে ধরেছেন নিজেদের দলে। ফলে শিবরাজের অনেক হিসেব গোলমাল হয়ে গিয়েছে। সরকার গঠনে নির্ণায়ক হয়ে ওঠা মালওয়া-নিমাড় তো বটেই, ভোপাল, বিন্ধ্য, মহাকোশল অঞ্চলেও সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছে মধ্যপ্রদেশের শাসক দল।

যে সব আসনে জয় আসবে বলে ধরে নিয়েছিল বিজেপি, তার মধ্যে অন্তত ৬০টা আসন থেকে নেতিবাচক রিপোর্ট এসেছে। কোথাও সঙ্ঘ ময়দানে নামেনি বলে হাল খারাপ। কোথাও আবার টিকিট না পেয়ে হেভিওয়েট নেতারা নির্দল হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে পড়েছেন বা কংগ্রেসের টিকিট নিয়ে নিয়েছেন।

অস্বস্তি সবচেয়ে বেশি হোশঙ্গাবাদ জেলায়। গোটা জেলাটাই বিজেপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। হোশঙ্গাবাদ কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন রাজ্য বিধানসভার স্পিকার সীতাশরণ শর্মা। পার্শ্ববর্তী সিবনী মালওয়া আসন ছিল রাজ্যের বনমন্ত্রী সরতাজ সিংহের। অটলবিহারী বাজপেয়ীর ১৩ দিনের মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন এই সরতাজ। এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা এবং জনসংযোগ নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। সেই সরতাজ এ বার টিকিট না পেয়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন এবং হোশঙ্গাবাদ থেকে লড়ছেন। বিজেপি নেতারা বলছেন, সরতাজের লক্ষ্য শুধু নিজে জেতা নয়, গোটা জেলায় বিজেপির বাড়া ভাতে ছাই দেওয়া। নিজের কেন্দ্র সিবনী মালওয়ায় যদি লড়তেন সরতাজ, তা হলে ওই একটা আসন নিয়েই সংশয়ে থাকতে হত বিজেপি-কে। কিন্তু সরতাজ লড়ছেন হোশঙ্গাবাদ থেকে, স্পিকারের বিরুদ্ধে। ফলে স্পিকার নিজে কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি। সঙ্গে সিবনী মালওয়াও অনিশ্চিত, কারণ সেখানেও সরতাজের লোকজন কংগ্রেসে সামিল হয়ে গিয়েছেন।

রাজ্যের প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রী রামকৃষ্ণ কুসমারিয়াও এ বার বিদ্রোহী। বয়সের কারণে টিকিট দেওয়া হয়নি তাঁকে। কিন্তু তাঁকে অন্যতম তারকা প্রচারক হিসেবে ব্যবহার করার ইচ্ছা ছিল নেতৃত্বের। কুসমারিয়া সে সবে রাজি নন। পাথরিয়া এবং দামোহ— দু’টি আসন থেকে তিনি নির্দল হিসেবে লড়ছেন। দামোহে তাঁর লড়াই রাজ্যের অর্থমন্ত্রী জয়ন্ত মালাইয়ার বিরুদ্ধে।

মধ্য জব্বলপুর আসনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী শরদ জৈনের বিরুদ্ধে নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছেন যুব মোর্চার প্রাক্তন সভাপতি ধীরজ পটেরিয়া। আর এক প্রাক্তন মন্ত্রী কে এল অগ্রবাল নির্দল হিসেবে লড়ছেন বামোরি থেকে।

জবলপুরে প্রচারের কাজে শিবরাজ সিংহ চৌহান।

তালিকাটা আরও অনেক লম্বা। অন্তত ৫৩ আসনে বিদ্রোহীরা বিপদে ফেলে দিয়েছেন বিজেপি-কে। এর চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যক বিদ্রোহী নির্দল হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। তাঁদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিরস্ত করা গিয়েছে। সেই সংখ্যাটা শতাধিক। কিন্তু এই ৫৩ জনকে আর ‘ম্যানেজ’ করতে পারেননি শিবরাজরা। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁদের ৬ বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে বিজেপি।

কিন্তু বহিষ্কার করলেই যে সমস্যা মিটে যাচ্ছে, তেমন নয়। রামকৃষ্ণ কুসমারিয়া, কে এল অগ্রবাল, সরতাজ সিংহ বা গ্বালিয়রের প্রাক্তন মেয়র সমীক্ষা গুপ্তদের নিজস্ব জনভিত্তিও সমীহ করার মতো। অতএব শিবরাজ এখন আরএসএসের দরজায়।

আরও পড়ুন: অনাপ-শনাপ পয়সা! কৃষক হত্যার মন্দসৌরেও উদ্বেগে থাকতে হচ্ছে কংগ্রেসকে​

বৃহস্পতিবার রাত পৌনে বারোটা নাগাদ আরএসএসের মধ্য ক্ষেত্রীয় সদর দফতর ‘সমিধা’য় পৌঁছন শিবরাজ। ক্ষেত্র প্রচারক দীপক বিস্পুতের সঙ্গে তাঁর দেড় ঘণ্টার বৈঠক হয়। আসন ধরে ধরে সমস্যা কথা জানান শিবরাজ। খবর বিজেপি সূত্রের। রাত দেড়টা নাগাদ তিনি নিজের সরকারি বাসভবনে ফেরেন। সঙ্ঘের তরফ থেকে শিবরাজকে ঠিক কী আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা কিন্তু স্পষ্ট নয়।

বিজেপির সর্বভারতীয় সমীকরণে নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহের সঙ্গে শিবরাজ সিংহ চৌহানের ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি নয়। কিন্তু মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ যে এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা, তা মোদী-শাহও জানেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভাল ফল করার জন্য এখন মধ্যপ্রদেশে সরকার টিকিয়ে রাখা যে জরুরি, তাও মোদী-শাহ বোঝেন। তাই মধ্যপ্রদেশে গোলমাল বাড়তে না দিয়ে আপাতত শিবরাজেই আস্থা রাখতে চেয়েছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। সেই আস্থার সুযোগ নিয়ে শিবরাজ প্রায় একনায়কের মতো টিকিট বিলি করেছেন বলে রাজ্য বিজেপির-ই একাংশের অভিযোগ। ভোটের ফল যদি খারাপ হয়, তা হলে কৈলাস বিজয়বর্গীয় বা সুমিত্রা মহাজনরা তো ছেড়ে কথা বলবেনই না, সর্বভারতীয় নেতৃত্বের চোখেও তিনিই সবচেয়ে বড় খলনায়কে পরিণত হবেন— ভোটের কাছাকাছি পৌঁছে এ কথা এখন বেশ বুঝতে পারছেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। ‘ত্রাহি মধুসূদন’ বলে তাই এ বার সঙ্ঘের দরজায় হাজির শিবরাজ। শেষ কয়েক দিনে সঙ্ঘ নিবিড় প্রচারে নামুক, বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে কথা বলুক— শিবরাজ এমনটাই চাইছেন বলে খবর।

বিজেপির আরও একটা ভরসা, দলের প্রতি কর্মী-সমর্থকদের আনুগত্য। রাজ্য বিজেপির প্রবীণ নেতারা উমা ভারতীর উদাহরণ তুলে ধরছেন। উমার হাত ধরেই ১৫ বছর আগে মধ্যপ্রদেশে দিগ্বিজয় সরকারের পতন ঘটিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু পরে সেই উমাকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরানো হয়। এক সময়ে উমা বিদ্রোহ করেন, আলাদা দল গড়েন। কিন্তু বিজেপি-কে বিপাকে ফেলা তো দূরের কথা নিজেও জিততে পারেননি টিকমগড় থেকে। বিদ্রোহীরা এ বারও সম্ভবত দাগ কাটতে পারবেন না— এই বলে আপাতত নিজেদের আশ্বস্ত করছে শিবরাজ শিবির।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন