মেয়ের পছন্দের পোশাক পরেই শপথ বাবুলের

গান নিয়ে দিব্যি ছিলেন। সিনেমার একটা স্ক্রিপ্টও লিখছিলেন। তার পর হঠাৎ একদিন বিমানে রামদেবের সঙ্গে দেখা, জীবনের স্ক্রিপটাই বদলে গেল! আসানসোলের কঠিন মাটিতে লড়ে এই সে দিন সাংসদ হয়েছিলেন। আজ কেন্দ্রীয় সরকারে নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হলেন বাবুল সুপ্রিয়! রাইসিনা পাহাড়ে শপথ নেওয়ার সময় প্রথামাফিক শুরুটা ধরিয়ে দিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, “আমি”। মোদী মন্ত্রিসভায় বাংলার প্রথম মুখ বলে গেলেন, “আমি বাবুল সুপ্রিয় বড়াল, ঈশ্বরের নামে শপথ নিচ্ছি..।”

Advertisement

শঙ্খদীপ দাস

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২১
Share:

শপথ গ্রহণ শেষ। এ বার নতুন ভূমিকায়। অন্য সহকর্মীদের হাততালির মধ্যে মঞ্চ থেকে নামছেন মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। রবিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

গান নিয়ে দিব্যি ছিলেন। সিনেমার একটা স্ক্রিপ্টও লিখছিলেন। তার পর হঠাৎ একদিন বিমানে রামদেবের সঙ্গে দেখা, জীবনের স্ক্রিপটাই বদলে গেল!

Advertisement

আসানসোলের কঠিন মাটিতে লড়ে এই সে দিন সাংসদ হয়েছিলেন। আজ কেন্দ্রীয় সরকারে নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হলেন বাবুল সুপ্রিয়!

রাইসিনা পাহাড়ে শপথ নেওয়ার সময় প্রথামাফিক শুরুটা ধরিয়ে দিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, “আমি”। মোদী মন্ত্রিসভায় বাংলার প্রথম মুখ বলে গেলেন, “আমি বাবুল সুপ্রিয় বড়াল, ঈশ্বরের নামে শপথ নিচ্ছি..।”

Advertisement

অদৃশ্য পর্দায় ফ্ল্যাশব্যাকে তখন অন্য একটা ছবি দেখা যাচ্ছে! ৪ মে, ২০১৪। ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা। তপ্ত আসানসোলে দাঁড়িয়ে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী বক্তৃতা দিচ্ছেন, “মুঝে দিল্লি মে বাবুল চাহিয়ে।”

এখনও কি সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে? দু’টো আইফোন সিক্সে সমানে ফোন আসছে! কিছুটা আনমনা বাবুল বললেন, “জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্ন তো ছিলই। পথটা অজানা ছিল।”

বৃহস্পতিবারই দুবাই থেকে মুম্বই ফিরেছেন। ডেঙ্গির আক্রমণটা কানের ধার ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছে। ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে বসেছেন কি বসেননি, অজানা নম্বর থেকে ফোন এল তিন বার। ধরতে ইচ্ছা হয়নি। শেষমেশ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে এক আমলা ফোন করে বললেন, “বাবুল ফোনটা ধরুন। প্রধানমন্ত্রীজি কথা বলবেন।” তক্ষুনি বাবা মা-কে ডেকে সামনে বসিয়ে ফোন ধরেছিলেন। ও পার থেকে ভেসে এল গলা, “বাবুল আপকো দিল্লি আনা হ্যায়!”

বিজেপি সূত্র বলছে, কেন্দ্রে প্রথমবার মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ই বাবুলকে মন্ত্রী করার একটা প্রস্তাব ছিল। মন্ত্রিসভা গঠনের সময় তাঁকে দিল্লিতে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। মন অবশ্য বলছিল, এত তাড়াতাড়ি কিছু হওয়ার নয়, হওয়া ঠিকও নয়। তবু বন্ধুরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, “এতটা ক্যাজুয়াল থাকিস না। নিজে অন্তত প্রস্তুত থাক।” ওঁদের পরামর্শেই দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে তড়িঘড়ি ধুতি-পাঞ্জাবি কিনে আনা হয়েছিল। মায়ের জন্য একটা নতুন দক্ষিণী শাড়ি। সেগুলো এখনও দেরাজে তুলে রাখা আছে। মেয়ের আবদার ছিল, “বাপি এ বার সাদা কুর্তা-পাজামা পরো। সঙ্গে ডার্ক ব্লু হাফ জ্যাকেট। মোদীজির মতন।” পছন্দ করে মেয়েই কিনে এনেছিল কুর্তা-পাজামা। শপথ গ্রহণের সময় আজ সেটাই পরলেন বাবুল। পায়ে নাইকি-র ক্যাম্বিসের জুতো। বাঁ হাতের কব্জিতে আর্মানির বড় ডায়ালের ঘড়িটা।

গায়ক বাবুল থেকে সাংসদ বাবুল। এখন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল! দায়িত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কি বদলে যাচ্ছেন মানুষটা?

প্রশ্ন করার দরকার হল না। শপথ গ্রহণের শেষে ফোনে ধরতেই বললেন, “দাঁড়ান আসছি।” সটান চলে এলেন, রফি মার্গে। গাড়িতে বাবা, মা আর মেয়ে শর্মিলী। রাইসিনা হিলের চা স্বাদু। তবে নানা জনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শান্তিতে গলা ভিজোনোর সুযোগ হয়নি। বললেন, “আগে চা খাই।” ক্রিম রোলের আস্ত একটা প্যাকেটও কিনে আনলেন নিজে, “মেয়েকে দিল্লির ক্রিম রোল খাওয়াতে হবে না!” এক টুকরো ভেঙে মেয়ের মুখে পুরে দিলেন।

বিট্টল ভাই পটেল হাউসের সামনে চায়ের দোকান। নয়াদিল্লিতে এটা সাংসদদের সরকারি আবাসন। ঘনশ্যামের দোকানে আখছার সাংসদরা আসেন। কিন্তু শপথ নিয়েই কোনও মন্ত্রী দুম করে চা খেতে নেমে পড়ায় পোড় খাওয়া ঘনশ্যামও কিছুটা ঘেঁটে গেলেন। চায়ের দোকানের সামনেই প্রথম পাতার পর বসে চলল আড্ডা, সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ‘বাইট’ দেওয়া, সাক্ষাৎকার, সৌজন্য বিনিময়।

কী বলবেন একে? আমআদমি-র রাজনীতি? গিমিক? নাকি বাবুল সুপ্রিয় জানেন রাজনীতিতে এমন মাটির মানুষই চাইছেন জনতা? ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র রিমেকে উত্তমকুমারের চরিত্র করার পর থেকে ক্যামেরাটাও তো বোঝেন! মুচকি হাসলেন বাবুল। বললেন, “জানেন তো আমি আমার মতো। মন্ত্রী হয়েছি মানে বড় ক্লাবে সই করেছি এমন নয়!” বাবা সুনীলচন্দ্র বড়ালের গলা বুজে আসছে আবেগে। বললেন, “বিদেশি ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়েছিল। বাপ-ছেলে একসঙ্গে অফিসে বেরোতাম। ভেবেছিলাম একদিন বড় অফিসার হবে। বিশ্বাস করুন, মন্ত্রী হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।” পাশে দাঁড়িয়ে মা অপলক চেয়ে রয়েছেন। সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বললেন, “আমার ছেলেটা বড় সাদাসিধে। যেখানেই যাবে, বাবা-মা থাকা চাই।” মেয়ে শর্মিলী নামেও লাজুক, স্বভাবেও। বাবুলই ঠেলে দিলেন ক্যামেরার সামনে। মেয়ে বলল, “জানি বাপির কাছ থেকে আরও কম সময় পাব। তবু কাজ তো আগে।”

সন্দেহ নেই এই আবেগ, এই মুহূর্তটা একান্ত ব্যক্তিগত। সেখানে রাজনীতির হয়তো প্রবেশাধিকারও নেই। কিন্তু সেই রাজনীতিই এখন সব এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে গেল! বাবুলের শরীরের ভাষায় অবশ্য হেলদোল হল না। বললেন, “মাত্র কয়েক দিন হল রাজনীতিতে এসেছি। এর মধ্যেই এত বড় দায়িত্ব দিলেন ক্যাপ্টেন। জানেন তো, মোদীজি-কে গোড়া থেকেই ক্যাপ্টেন বলি। ওঁকে বলেছি, দায়িত্ব পালনে কোনও ত্রুটি রাখব না।” সামনেই রাজ্যে পুরভোট। তার আগে বাবুলকে নগরোন্নয়ন, আবাসন ও নগর এলাকার দারিদ্র্য দূরীকরণ মন্ত্রকেরই প্রতিমন্ত্রী করেছেন মোদী।

শুধু মন্ত্রক নয়, বাবুল জানেন তাঁর উপর রাজনৈতিক দায়িত্বও এখন কতখানি। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রীর তখত থেকে নামানোর পণ করেছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি। বাবুল এখন তাঁদের তুরুপ-তাস। তবু শপথ গ্রহণের দিন রূঢ় রাজনৈতিক আক্রমণে যাওয়ার মন নেই আসানসোলের সাংসদের। বাবুল জানেন, এ দিনই তাঁকে ‘হাফ-মন্ত্রী’ বলে কটাক্ষ করেছেন মমতার মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি কিন্তু পাল্টা ঝাঁঝ না দেখিয়ে বলেছেন, “হাফ-মন্ত্রী হলেও মন্ত্রী তো! কাজ করতে পারলে হাফ-মন্ত্রীই মানুষের সমর্থন পাবেন!” এ দিন সকালেই চায়ের আসরে মোদী নতুন মন্ত্রীদের দারুণ উদ্বুদ্ধ করেছেন যে! মন্ত্রক সামলে দলের কাজ করার সময় পাবেন? আধ সেকেন্ডও সময় না নিয়ে কেন্দ্রে নতুন মন্ত্রীর জবাব, “একটা দায়িত্ব পেলে মানুষ কি অন্য দায়িত্ব ভুলে যায়? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বাড়ে। কাঁধ চওড়া হয়।” বাবুল ভুলে যাচ্ছেন না, রাজ্যে বিজেপির লক্ষ্য কী। মোলায়েম সুরেই বললেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রাজনীতিটা আমদানি করেছেন, সেটা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিরোধী। ২০১৬ সালে বাংলাকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হবে।”

আর গান? “সেও থাকবে। ওটা ভালবেসে গাই। ওটাই জীবনীশক্তি। মোদীজি বলেছেন, গান ছেড়ো না বাবুল। ওটা ধরে রেখো। বি ইন ইওর ওন সেল্ফ।” কথা শেষ না করে মন্ত্রীই জানালেন, “এবং ফুটবলও থাকবে, আমার ব্রাজুকা বল।” চাণক্যপুরীর মাঠে সুযোগ পেলেই বাবুল সুপ্রিয় বল নিয়ে দাপাদাপি করেন। সে দিন তো ফুটবল গিয়ে পড়েছিল নরওয়ে দূতাবাসের চৌহদ্দির মধ্যে। বল ফেরত দিতে চাইছিল না। জার্সি প্যান্ট পরা, হাতে-পায়ে ধুলো মাখা সাংসদ আগে দূতাবাস কখনও দেখেনি। নরওয়ে সফরে গিয়ে সরকারি মধ্যাহ্নভোজে প্রিন্স আর প্রিন্সেসকে সে গল্প শোনাতে ওঁরাও হেসে খুন।

এর পরেও বলবেন, সাংসদ থেকে মন্ত্রী হয়ে বদলে গেলেন বাবুল? ভাইরাসের প্রকোপে দুর্বলতা এখনও কাটেনি। অ্যান্টিবায়োটিক চলছে। প্লেটলেট কাউন্টটা এর মধ্যে চেক করলেন? বাবুল এক গাল হেসে নিজস্ব কেতায় বললেন, “না চেক করিনি, আজ দুপুরেই তো প্লেটলেট নিলাম। মন্ত্রিসভায় শপথ নিলাম যে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন