রথ দেখা যাবে এই ছাদ থেকে। চলছে তারই প্রস্তুতি। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
মন্দিরের সিংহ দরজায় প্রকাণ্ড গোঁফওলা সিংহটার মুখোমুখি সামান্য বাঁয়ে উঠে গিয়েছে সিঁড়িটা। গ্রন্থাগারের মাথায় ছাদটাও সম্প্রতি নতুন করে ঢালাই হয়েছে।
ছাদে দাঁড়ালে মন্দিরের ভোগরান্নার চত্বর বা সিংহ দরজার ভিতরের জয়-বিজয় দরজা বা অপূর্ব কারুকার্য করা ভোগমণ্ডপ—সবই স্পষ্ট দেখা যায়। রথের সকালে সেই ভোগমণ্ডপের সামনে দিয়েই জয়-বিজয় দরজা পেরিয়ে ‘পাহুণ্ডি বিজয়’-এ জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা সিঁড়ি দিয়ে টুকটুক করে নেমে আসবেন।
আজ, রথযাত্রার তিন দিন আগে তরতরিয়ে সেই ছাদে উঠে যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কাল থেকেই এই ছাদের দখল নেবে পুলিশ-প্রশাসন। জগন্নাথ মন্দিরের পাড়ায় একটু কান পাতলেই শোনা যায়, এ তল্লাটে সব ছাদই নিলাম হয়ে গিয়েছে। রীতি মতো দরপত্র ডেকে ছাদের স্বত্ব বিলি হয়েছে ইতি-উতি। শোনা যাচ্ছে, নবকলেবরের বছরে সর্বকালীন রেকর্ড ছুঁয়েছে এই দরাদরি। মন্দিরের প্রধান ফটকের ঠিক বাঁ দিকের ছাদ দু’লক্ষ টাকায় বিকিয়েছে। ক্যামেরা ঘাড়ে ছাদে ছবি তোলার জন্য অনেকেই দু’-পাঁচ হাজার টাকাও সানন্দে উত্সর্গ করছেন।
রথে ওঠার আগে বিগ্রহের ‘পাহুণ্ডি বিজয়’ চাক্ষুষ করার এই ছাদটাই মোক্ষম লোকেশন। সংস্কৃত ‘পাদহুণ্ডন’ থেকে ওড়িয়া পাহুন্ডি শব্দের জন্ম। মন্দিরের দয়িতাপতিরা বলে থাকেন, প্রভু না কী নিজেই রত্নবেদী থেকে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সিংহদরজার বাইরে রথারোহণ করেন। তারপরে হয়তো একটু থেমে বলবেন, আমরা, প্রভুর ভাইরাই তাঁর হাত-পা হয়ে উঠি।
জলজ্যান্ত ‘মিথ’ চাক্ষুষ করতে রথযাত্রার দিনে মন্দিরে ঢোকার টিকিটও দেদার বিকোচ্ছে। পুব দিকের সিংহদুয়ার বাদ দিলে উত্তরের হাতি, পশ্চিমের বাঘ বা দক্ষিণের ঘোড়া দরজা দিয়ে টিকিট কেটে ভক্তরা মন্দিরে ঢুকতে পারবেন। সবার জন্যই ৫০ টাকার টিকিট। সার্কিট হাউজে ভিআইপি-দের মধ্যেও ‘পাহুণ্ডি বিজয়’ দর্শনের টিকিটের জন্য হা-পিত্যেশ চলছে। মন্দিরের মুখ্য প্রশাসনিক আধিকারিক, আইএএস অফিসার সুরেশ মহাপাত্র অবশ্য সতর্ক। মন্দিরের ভিতরে কোনও ভাবেই যাতে দু’হাজারের বেশি লোক না ঢোকে সে ব্যাপারে কঠোর তিনি। কয়েক বছর আগে, কার্তিক ব্রতের সময়ে মন্দিরের ভিতরে চার জন ভক্তের পদপিষ্ট হওয়ার নজির রয়েছে তাঁর সামনে।
কিন্তু নবকলেবরের বছরে, দেড় মাসের ব্যবধানে প্রভুকে দেখবে জনতা! তাই ভিড় কেমন হতে পারে, তা আঁচ করছে প্রশাসন। ওড়িশা পুলিশের ডিজি সঞ্জীব মারিকের হিসেব, ‘‘অন্য বারের তুলনায় এ বার ভিড় দ্বিগুণ হবেই। বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড হাইকোর্টের জজসাহেব থেকে শুরু করে মান্যগণ্য অনেকেরই আসার কথা।’’ অর্থাত্ অন্তত ২০ লক্ষ মানুষের ভিড় হওয়ার সম্ভাবনা।
প্রভুকে দেখার টানে ভক্তরা তো সমুদ্রের ধারে বালিতে শুয়েই রাত কাবার করে দেবেন। তবে প্রশাসনের তত্পরতায় কাল, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই খুলে যাচ্ছে ২৯টি নবকলেবর গ্রাম। রথ ও নবকলেবর উদ্যাপনের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা আইজি (অপারেশন) সৌম্যেন্দ্র প্রিয়দর্শীর পরিকল্পনা, ভিড়টাকে মন্দির লাগোয়া গ্র্যান্ড রোড থেকে পুরো রথ চলাচলের রুটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ২০০৮ সালের রথে, ভিড়ের চাপে চার জনের মৃত্যুর নজির রয়েছে। ২০১০ সালেও পড়ে গিয়ে এক বৃদ্ধা মারা গিয়েছিলেন। এ সব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই প্রশাসন এগোতে চায়।
তবে পাহুণ্ডি বিজয়-এর সময়টা নিয়ে এ বার এখনও মন্দির-চত্বরে বিতর্ক চলছে। সরকারি ভাবে ঠিক হয়েছে, সকাল ন’টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক, আমলা-মন্ত্রীবর্গ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যের ভিআইপি-রা তা দেখবেন। প্রশাসনের পরিকল্পনা, বেলা একটা পর্যন্ত চলবে পাহুণ্ডি বিজয়।
তবে মুখ্য দয়িতাপতি জগন্নাথ সোয়াঁইন মহাপাত্র বা দয়িতাপতি সংগঠনের সভাপতি রামকৃষ্ণ ওরফে রাজেশ দয়িতাপতি চান, আচার-অনুষ্ঠান আরও আগে শুরু হোক। তা না হলে রথযাত্রায় দেরি হবে। বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ রথ চলা শুরুর কথা। তার আগে পুরীর গজপতি মহারাজ সোনার ঝাড়ু দিয়ে রথের পথ পরিষ্কার করবেন। নিয়ম অনুযায়ী, সন্ধে হয়ে গেলে রথ যেকানে পৌঁছবে, সেখানেই থেমে যাবে।
এই যাত্রার বিচিত্র আচার-অনুষ্ঠান ভাল ভাবে দেখার টানেই মন্দিরের আশপাশের সব হোটেল এখন আকাশছোঁয়া দর হাঁকছে। শিয়ালদহ থেকে আসা আটজনের একটি পরিবার এখন মন্দিরের বাঘ দরজার কাছে, বিষ্ণু মঠে রয়েছেন। তবে রথের দিন তাঁদের ঘর ছেড়ে দিতে হবে। ৪৫০ টাকার ঘর ৪০০০ টাকায় বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বড় দণ্ড বা গ্র্যান্ড রোডমুখী ঘর হলে দর আরও চড়া। পুরীতে সি-ফেসিং এসি ঘরের দামও তার কাছে নস্যি।
মন্দিরের দু’-দশ পা দূরে ধর্মজ্যোতি হোটেলের ছোকরা ম্যানেজারকে ঘরের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই একমুখ হাসি, রাস্তার দিকের সাধারণ ঘর, এসি-টেসি নেই, এমনিতে ২৫০ টাকা ভাড়া। এখন সাত হাজার টাকা লাগবে। আর মন্দিরের সামনের রাস্তায় দাঁড়ালেই, দালালরা মন্দিরের পিছন দিকের হোটেলে রথের আগে-পিছে দু’দিন চার-পাঁচ হাজার টাকায় থাকবার সুবন্দোবস্তের লোভ দেখাচ্ছেন।
মন্দিরের আশপাশে সব উঁচু ছাদই কার্যত বিক্রি হয়ে গিয়েছে। মন্দিরের ডান দিকের মঠের ছাদ না কী জেলা প্রশাসনই অধিকার করে নিয়েছে। সেখানে বেশ কিছু বিশিষ্ট অতিথির বসার বন্দোবস্ত হবে। সিংহ দরজা থেকে মন্দিরের উত্তরের হাতি দরজায় যাওয়ার রাস্তায় জেলা তথ্য ও জনসংযোগ দফতরের যে বাড়িটায় সদ্য স্বাধীনতাসংগ্রামী গোপবন্ধু দাসের মূর্তি বসানো হল, সেই ছাদে বসবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক। মন্দিরের উল্টো দিকে, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ছাদও ‘দখল’ হয়ে গিয়েছে।
কয়েকটি ছাদের গায়ে ওড়িয়া অক্ষরে ‘অসুরক্ষিত’ লেখা। অর্থাত্ তা বিপজ্জনক। তাতে কী? প্রচলিত লোকবিশ্বাস বলছে, রথে জগন্নাথ-দর্শনের পুণ্যে জীবযন্ত্রণার ভোগান্তি থেকে নিশ্চিত মুক্তি। অতএব, লোকের মনের ভয়-টয় সব উড়ে গিয়েছে।
প্রশাসন অবশ্য তাতে নিশ্চিন্ত নয়। রথের আগেই পড়শি রাজ্য অন্ধ্রের রাজামুন্দ্রিতে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই গোদাবরীতে পুণ্য স্নানের সময়ে ৩৫ জনের মৃত্যু হল। তা ছাড়া, এই নবকলেবরের বছরে ব্রহ্ম বা ঘট-পরিবর্তন নিয়ে এমনিতেই রাজ্যের বিজেডি সরকার অস্বস্তিতে রয়েছে।
জগন্নাথধামে নতুন করে আর ছিটেফোঁটা অঘটনও প্রশাসনের কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়।