প্রথম মহিলা হিসাবে শবরীমালায় ঢুকেছিলেন বিন্দু আম্মিনি। কেরল ছেড়ে এখন থাকেন দিল্লিতে। —ফাইল চিত্র।
লড়াইটা যখন শুরু হয়েছিল, তখনই তাঁরা একঘরে। এখনও তা-ই। তবে এখন শুধুই একঘরে নন, ‘রাজ্যছাড়া’ বিন্দু আম্মিনি। শতাব্দী প্রাচীন রীতি ভেঙে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে যিনি প্রথম ঋতুমতী মহিলা হিসাবে শবরীমালা মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকেছিলেন।
শবরীমালায় প্রবেশের পর পেশায় আইনজীবী বিন্দু নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। রাজনীতিবিদ থেকে রাজনৈতিক কর্মী, দক্ষিণপন্থী সংগঠন থেকে সাধারণ মানুষের একাংশ তাঁকে ধর্মীয় ভাবাবাগে আঘাত করার অভিযোগে বিদ্ধ করেছেন। সেই ক্ষত এতটাই গভীর যে নিজের বাড়ি, নিজের শহর তথা নিজের রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সম্প্রতি ‘দ্য নিউজ মিনিট’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিন্দু বলেন, ‘‘দক্ষিণপন্থী সংগঠন থেকে চাপ আসবে জানতাম। কিন্তু রাজ্যের বাম সরকারের প্রতি আস্থা ছিল। তারাও... নিঃশব্দে ছুরিটা মেরেছে ওরাই।’’
প্রথম মহিলা হিসাবে শবরীমালায় প্রবেশ করা বিন্দু এখন দিল্লির বাসিন্দা। মাসখানেক হল রাজধানীর ময়ূরবিহারে ছোট্ট একটি অফিস খুলেছেন তিনি। নয় নয় করে দু’বছর হল দিল্লিতে আছেন। পাকাপাকি ভাবে থাকার কথা এখনও ভাবেননি। জানালেন, নিজেকে তাঁর উদ্বাস্তু বলে মনে হয়। কেন নিজের বাড়িঘর ছেড়ে ভিন্রাজ্যে থাকতে হল? বিন্দুর জবাব, ‘বাধ্য হয়ে।’
‘দ্য নিউজ মিনিট’কে বিন্দু বলেন, ‘‘কেরলে থাকা আমার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল।’’ শবরীমালা মন্দিরে সব বয়সের মহিলাদের প্রবেশাধিকারের পক্ষে তো রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল কেরলে। রাজনৈতিক চাপানউতরও তৈরি হয়। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। পিনারাই বিজয়নের সরকার জানিয়েছিল, আদালতের নির্দেশ তারা বলবৎ করবেই। যে মহিলারা মন্দিরে প্রবেশ করবেন, তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে সরকার তথা প্রশাসন। ওই কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন বিন্দু। তাঁর কথায়, ‘‘আর যা-ই হোক, ডানপন্থীরা প্রকাশ্যে হিংস্র। কিন্তু কেরলের বাম সরকার? এরাই নীরবে ছুরি মেরেছে আমায়।’’ আর বড় চুল রাখেন না বিন্দু। ছোট করে ছাঁটা চুল দেখিয়ে বলেন, ‘‘এই যে, এটা কেন করেছি? যাতে চট করে কেউ চিনতে না পারে যে আমিই বিন্দু আম্মিনি।’’ তার পর বলেন, ‘‘তবে ভালই হল। বড় চুল সামলানো বেশ ঝক্কির ছিল।’’
শবরীমালার গর্ভগৃহে ঢোকা প্রথম মহিলা জানান, ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারির পর তাঁর জীবন বদলে গিয়েছে। ৭ বছর আগে সে দিন বন্ধু কনকদুর্গাকে নিয়ে শবরীমালার সিঁড়ি ভেঙেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল আরও ৭০০ মহিলা। কিন্তু হিংসাত্মক বিক্ষোভ, প্রতিরোধের মুখে পড়ে বেশির ভাগই বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। বিক্ষোভ সামলাতে গিয়ে ইটের বাড়ি, লাঠির ঘা খেয়েছে পুলিশ। সরকারি যানবাহন ভেঙেছে। তা-ও পুরনো, জীর্ণ রীতি ভাঙতে প্রত্যয়ী ছিলেন দুই মহিলা— বিন্দু ও কনকদুর্গা। বিন্দুই প্রথম ঢোকেন গর্ভগৃহে। তার পরে কনকদুর্গা।
ওই দিনের পর থেকে নানা অস্বস্তিকর এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন দুই মহিলা। বিন্দু বলেন, ‘‘রাস্তাঘাটে যখন-তখন আমায় অপদস্থ করেছে একদল অচেনা মুখ। এক বার একটা অটোরিকশা প্রায় পিষে দিচ্ছিল আমাকে। তার পর প্রতিনিয়ত খারাপ কথা, খারাপ ইঙ্গিত ছিলই।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এমনকি, মানুষ আমার ছবি নিয়ে বিকৃত করে নগ্ন ভিডিয়ো বানিয়ে পর্ন সাইটে ছড়িয়েছে। বাকি আর কী রেখেছে!’’ হতাশা ঝরে পড়ে মহিলার চোখেমুখে।
বিন্দুর অভিযোগ, অনেক বার তিনি কেরল পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু সাহায্য পাননি। তিনি জানান, ২০২৫ সালের ২৮ অগস্টের কথা। সাইবার সেলে অভিযোগ করেছিলাম ছবি এবং ভিডিয়ো বিকৃতি নিয়ে। কাজ হয়েছে? বিন্দু বলেন, ‘‘দিন আষ্টেক আগে কৌতূহলের বশে ফোন থেকে সংশ্লিষ্ট সাইট খুলেছিলাম। কী বলব? এখন ২০ লক্ষ ভিউজ়! দেখুন, এখনও ভিডিয়োটি যেখানে থাকার সেখানেই আছে। এগুলো থামবে না।’’
তবে ‘সামাজিক ভাবে হেনস্থা’ বিন্দুর কাছে নতুন কিছু নয়। তিনি বলেন, ‘‘জন্মসূত্রে আমি দলিত। যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে, আমাদের প্রতি বিদ্বেষ, হিংসাই দেখে আসছি।’’
সময় গড়িয়েছে। বিন্দু, কনকদুর্গার কথা ভুলেছেন বেশির ভাগ মানুষই। এর মধ্যে ত্রাবণকোর দেবস্বোম বোর্ড, যারা শবরীমালা মন্দির পরিচালনার দায়িত্বে, তাদের ৭৫তম জন্মতিথি পালন করবে কেরল সরকার। আগামী ২০ সেপ্টেম্বরই সেই অনুষ্ঠান। বিন্দু তো শবরীমালার ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। আমন্ত্রণ পেয়েছেন? ‘দ্য নিউজ মিনিট’-কে মধ্যবয়স্কা বললেন, ‘‘আমায়? কে ডাকবে আর কেনই বা ডাকবে?’’