কেন চলে গেলে আম্মা, কাঁদল বেদখল চেন্নাই

তেরো বছর চেন্নাইয়ে রয়েছি। একটা ভাবলেশহীন ব্যাপার রয়েছে শহরটার। কিন্তু আম্মার চলে যাওয়া নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে তামিল শিকড়টাকেই। সঙ্গে আমাকেও।

Advertisement

রুদ্র চট্টোপাধ্যায়

চেন্নাই শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:২৩
Share:

সুনসান রাজপথ। মঙ্গলবার চেন্নাইয়ে। ছবি: রেঙ্গাস্বামী চিদম্বরমনাথন।

তেরো বছর চেন্নাইয়ে রয়েছি। একটা ভাবলেশহীন ব্যাপার রয়েছে শহরটার। কিন্তু আম্মার চলে যাওয়া নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে তামিল শিকড়টাকেই। সঙ্গে আমাকেও।

Advertisement

ভিনরাজ্যে অফিস-বাড়ি-শপিং মলে চরকি কেটে বেঁচে থাকা আমিও তাই বসে থাকতে পারিনি বহুতলের বারান্দায়। জানি, শহর অচল। তবুও সকাল থেকেই মন টানছে আন্নাসলাই। যেখানে আম্মাকে শায়িত রাখা থাকবে বিকেল সাড়ে ৪টে পর্যন্ত।

রাস্তায় নেমেই অপেক্ষা। তাম্বারামের এমন চিত্র কখনও দেখিনি। সব বন্ধ। এমনকী ইডলি-বড়ার দোকানও। বাড়ি থেকে তাম্বারাম স্টেশন পৌঁছতে অটো নেয় ১০ টাকা। মিনিটে তিনটে অটো মেলে। আজ কেউ নেই। দাঁড়িয়ে আছি আধ ঘণ্টা, ভাবছি গাড়ি বের করা ঠিক হবে কি না। এমন সময় একটা অটো এল। স্ট্যান্ডে আর কেউ নেই। ৫০ টাকা হাঁকলেন চালক। পৌঁছলাম তাম্বারাম স্টেশনে।

Advertisement

তাম্বারাম হচ্ছে কলকাতার গড়িয়ার মতো। চেন্নাইয়ের সমস্ত লোকাল ট্রেন যায় তাম্বারাম থেকে চেন্নাই বিচ স্টেশন পর্যন্ত। একে একে পেরিয়ে যায়— ওরাঘাডাম শিল্প তালুক, চেন্নাইয়ের গাড়ি কারখানা চত্বর। শ্রীপেরমপুদুর শিল্পাঞ্চল। শ্রীরাম তথ্যপ্রযুক্তি অঞ্চল, চেঙ্গলপেট শিল্পাঞ্চল...। সদা ব্যস্ত থাকে তাম্বারাম লাইন। তিলার্ধ জায়গা থাকে না থিকথিকে স্টেশনগুলোতে।

আজ ফাঁকা স্টেশনে আমি একা যাত্রী। একটা বেঞ্চে আম্মার ছবি। কেউ গোটা কয়েক প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছে। ডান হাতটা অজান্তেই কপালে উঠে গেল। ট্রেনের যে কামরায় উঠলাম, সেখানে মেরেকেটে জনা চার-পাঁচ লোক। রাস্তা সুনসান, যেন বন্‌ধ। যাত্রীদের কেউ একটা বললেন, ‘‘মোদী মোদী!’’ মোবাইলের স্ক্রিনে দেখলাম টিভি চ্যানেলের অ্যালার্ট, প্রধানমন্ত্রী আসছেন। সব বন্ধ থাকলেও ‘রাজা’ খোলা। চেন্নাইয়ে ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ডিএমকে নেতা, টুজি কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত এ রাজার নামেই পরিচিত হয়ে গিয়েছে। সেই ‘রাজা’ও আজ আম্মাময়। পর পর আপডেট। পার্ক স্টেশনে নামলাম। ততক্ষণে কামরায় কিছু লোকজন হয়েছে।

কিন্তু স্টেশন থেকে বেরোতেই চোখ ছানাব়ড়া। মাথা আর মাথা। অসংখ্য মহিলা। সংখ্যালঘুদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। এখান থেকে আন্নাসলাই ২ কিলোমিটার। এক দিকে চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে রাজাজি হল। অন্য দিকে এগমোর স্টেশন থেকে হেঁটে অরুণাচলম স্ট্রিট ধরে আন্নাসলাইয়ে আসা যায়। অনেকটা এক দিকে বাবুঘাট আর অন্য দিকে শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে মহাকরণে আসার মতো। আমি নেমেছি ধরা যাক বউবাজারের মতো এলাকায়। ফলে দু’দিকে শুধু লোক লোক।

কলকাতায় জ্যোতি বসু, সুভাষ চক্রবর্তীর মতো জননেতার শেষযাত্রা টিভিতে দেখেছি। ঘনঘন ‘অমর রহে’ স্লোগান শুনেছি। পতাকা দেখেছি হাজার হাজার। প্ল্যাকার্ড দেখেছি কত ধরনের। এখানে সে সব কিছু নেই। বাকরুদ্ধ জনতা। সোমবার অ্যাপোলো হাসপাতালের সামনে তাও কিছু শোরগোল হয়েছিল। আজ আর সেটুকুও নেই। যুবক-কিশোরদের হাতে শুধু আম্মার ছবি। এমনকী দলীয় পতাকাও নেই। মনে হতে পারে লাখো মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসও পড়ছে না। আমিও হাঁটছি। পাশে এন মুত্থকুমার। জানতে চাইলাম, ‘‘হোয়াই ক্রাউড ইজ নট অ্যাট অল এক্সপ্রেসিভ?’’ মুত্থকুমার বললেন, ‘‘নাথিং লেফট টু এক্সপ্রেস ব্রাদার।’’ ছলছল চোখে যোগ করলেন,‘‘শি ফট হার লাস্ট ব্যাটল ফর দ্য লাস্ট থ্রি মান্থস আনএক্সপ্রেসিভলি। হোয়াই শুড উই টুডে?’’

আজ দুঃখ প্রকাশের ভাষা নেই তামিলনাডুর। তাই স্লোগান নেই। অমর রহে নেই। শুধু গুমরে কেঁদে ওঠা মহিলার দল। ‘‘আম্মা, এনগালা ভিট্টুট্টু পইতিনগালে আম্মা!’’ আম্মা কেন চলে গেলে আম্মা? কেউ বা বলছেন, ‘‘এনগালাইয়াম কুট্টিট্টু পোঙ্গা।’’ মানে, আমাদেরও নিয়ে চলো আম্মা। মূলত দেহাতি মানুষ। শহর চেন্নাই তো নেই এই ভিড়ে। বাস, ট্রেন বন্ধের মাঝে এত মানুষ বাইরে থেকে এলেন কী করে? ভিড়েই পেয়েছি মনিকন্দনকে। সে জানাল, চেন্নাইবাসী তেমন বেরোয়নি রাস্তায়। আন্নাসলাইয়ের দখল নিয়েছে কাঞ্চীপুরম, তিরুভালুর, তিন্ডিভানম, ত্রিচি-র মতো জেলার মানুষ। যারা সোমবার থেকেই চলে এসেছিলেন। হাজারে হাজারে এসেছিলেন শ্রীরঙ্গম থেকে, যা ছিল আম্মার নির্বাচনী কেন্দ্র।

রাজাজি হল-এই শেষ বারের মতো শায়িত ছিলেন এমজিআর। আম্মাও শায়িত থাকলেন। তার পরে তিনি যাবেন মেরিনা বিচে। এমজিআরের সমাধির পাশে। তামিলদের কাছে তিনি ‘পুরাতচি থালাইভি’। বিপ্লবী জননেত্রী। কেউ বলেন ‘থাঙ্গা থারাগাই’ বা সোনার দেবী। আজ রাজাজি হল থেকে বেরনোর সময় অনেকেরই মুখে শুনলাম, ‘‘নিনগা এনগাল কোডাভুল, আম্মা।’’ তুমি আমাদের ভগবান। বিপ্লবী নেত্রী তবে এ বার দেবী হয়েই থাকবেন তামিল হৃদয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন