পরোক্ষ নিষ্কৃতি-মৃত্যুতে সায় থাকলেও তার উইল বা ইচ্ছাপত্রকে স্বীকৃতি দিতে রাজি ছিল না কেন্দ্র। মোদী সরকারের সেই আপত্তি খারিজ করে নিষ্কৃতি-মৃত্যুর উইল তথা আগাম নির্দেশিকায় অনুমতি দিল সুপ্রিম কোর্ট। তার যাতে অপব্যবহার না হয়, তার বিস্তারিত নিয়ম-কানুনও তৈরি করে দিল।
এই রায়ে ফের প্রকাশ্যে এসেছে সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের ক্ষমতার লড়াই। সুপ্রিম কোর্ট কেন নিয়ম তৈরি করবে, সেই প্রশ্নও উঠেছে। প্রধান বিচারপতি তাঁর রায়ে বলেছেন, ‘সংবিধানে দেওয়া অধিকার থেকেই যেখানে কারও উইল করা হয়েছে এবং যেখানে করা নেই, দুই ক্ষেত্রেই পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যুর নির্দেশিকা তৈরি করে দিচ্ছি।’
সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে মোদী সরকার যুক্তি দিয়েছিল, পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যুতে অসুবিধা নেই। কিন্তু সরকার আগেভাগে উইল করে যাওয়ার বিরুদ্ধে। কারণ বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিকিত্সার ভার থেকে মুক্তি পেতে সন্তানেরা এই উইলকে কাজে লাগাতে পারে। সরকার জানিয়েছিল, এই বিষয়টি দেখভালের জন্য খসড়া বিল তৈরি হয়েছে। খসড়া ‘মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট অব টার্মিনালি ইল পেশেন্ট (প্রোটেকশন অব পেশেন্টস অ্যান্ড মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার্স) বিল’-এ বলা হয়েছে, জেলা ও রাজ্য স্তরে মেডিক্যাল বোর্ড থাকবে। তারাই ঠিক করবে, জড় পদার্থের মতো মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা কোনও ব্যক্তিকে পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যু দেওয়া হবে কি না। সেই বিলের অপেক্ষায় না থেকে সুপ্রিম কোর্ট নিজেরাই নির্দেশিকা তৈরি করে দিয়েছে।
জটিলতা যেখানে
• এখন কোমায় চলে যাওয়া ব্যক্তির পরিবার চিকিৎসার খরচ বইতে না পারলে চিকিৎসকদের কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বা জীবনদায়ী ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু কাগজে-কলমে তা লেখা থাকে না। সবটাই হয় বেসরকারি ভাবে।
• নতুন ব্যবস্থাটি আইনসঙ্গত হল বটে, কিন্তু একই সঙ্গে জটিলও হল। কারণ, লিভিং উইল থাক বা না-থাক, নিষ্কৃতি মৃত্যু কার্যকর করতে হলে দু’টি মেডিক্যাল বোর্ডের অনুমতি প্রয়োজন। বোর্ড অনুমতি না দিলে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত মেটাতে হবে হাসপাতালের বিল।
• ফলে বেসরকারি ভাবে নিষ্কৃতি মৃত্যু চলতেই থাকবে বলে অনেকের মত। অনেকে আবার বলছেন, এখন চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর সহজে রাজি হবেন না। কারণ শীর্ষ আদালতের রায়ের অবমাননা হচ্ছে বলে মামলার ঝুঁকি বাড়বে।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ‘‘আগাম একটি চিকিৎসা নির্দেশিকা থাকলে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার নিরঙ্কুশ অধিকার রক্ষায় তা সাহায্য করবে। রোগীর চিকিৎসার সময়ে অনেক সন্দেহ এতে দূর হবে বলে আমরা মনে করি। যাঁরা চিকিৎসা করছেন, তাঁরাও নিশ্চিন্ত হতে পারবেন যে তাঁরা আইন মেনেই যা কিছু করছেন। কারণ, রক্ষাকবচ নিয়ে কোনও ধোঁয়াশা রাখা যায় না।’’ একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র অবশ্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, সরকার নতুন আইন আনা পর্যন্তই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা জারি থাকবে।
মহাভারতে ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী ছিলেন। কিন্তু অন্ধ্রের মৃত্যুপথযাত্রী কিশোর বেঙ্কটেশের নিষ্কৃতি-মৃত্যু চেয়ে মা সুজাতা অনুমতি পাননি। উল্টো দিকে সুপ্রিম কোর্ট মেনে নিয়েছে, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খরচের বোঝা থেকে মুক্তি পেতেও উইলের অপব্যবহার হতে পারে। যেখানে উইল নেই, সেখানে এ সুযোগ আরও বেশি। সেই কারণেই নির্দেশিকা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। সরকারি সূত্রের যুক্তি, আইন কমিশনই এর আগে বলেছিল, পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যুর অনুমতি দেওয়া উচিত। তার অপব্যবহার বন্ধ করার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। তার পর বিলের খসড়া তৈরি করা হয়।