নরেন্দ্র মোদী জমানার ন’মাসের মাথায় সংস্কারের পথে প্রথম বড় বাধা পেরোলো বিজেপি সরকার। আজ রাতে রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে গেল বিতর্কিত বিমা বিল। দরজা খুলল বিমা ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ বিদেশি লগ্নির। এত দিন যা ছিল ২৬ শতাংশ।
দীর্ঘ টানাপড়েনের পরে বিমা বিলে অধিকাংশ বিরোধী দলের সমর্থন আদায় করতেও সমর্থ হয়েছে বিজেপি। রাজ্যসভায় যে হেতু সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, সে হেতু বিরোধীদের সমর্থন ছাড়া বিল পাশ করা সম্ভব ছিল না। এবং দীর্ঘদিন ধরে তারা জমি বিলের মতো বিমা বিল নিয়েও সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছিল। আজ অবশ্য কংগ্রেস, এডিএমকে, এনসিপি বিলের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। ওয়াক আউট করেছে তৃণমূল এবং ডিএমকে। বিরোধিতা করেছে শুধু বামেরা।
বিরোধীদের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা হল কোন শর্তে? সূত্রের মতে, জমি বিল নিয়ে কিছুটা ধীরে চলা হবে, সূত্র এটাই। বিমা ক্ষেত্রের মতো জমি অধিগ্রহণ নীতিতেও যত দ্রুত সম্ভব বড় মাপের সংস্কার আনতে চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেই কারণে বিরোধীদের আপত্তি সত্ত্বেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের জন্য জমি মালিকদের সম্মতি নেওয়ার শর্ত খারিজ করে অধ্যাদেশ জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার। অধিগ্রহণের সামাজিক প্রভাব সংক্রান্ত সমীক্ষার শর্তও লঘু করে দেওয়া হয়। এ বার সেই অধ্যাদেশ সংসদে পাশ করানোর পালা। কিন্তু বেঁকে বসেছে বিরোধীরা। তাদের আপত্তি ছিল বিমা ও খনি অধ্যাদেশ নিয়েও। খনি বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে ইতিমধ্যেই সমঝোতা করেছে সরকার। জমি বিল নিয়েও সেই পথে হাঁটার আশ্বাসে তারা প্রশস্ত করল বিমা বিলের পথ।
এখন বিরোধিতা করলেও ২০০৮ সালে বিমা বিল কিন্তু সংসদে পেশ করেছিল ইউপিএ সরকারই। গোটা বিশ্ব জুড়ে তখন মন্দা। দেশে বিদেশি পুঁজির হাঁড়ির হাল। সেই অবস্থায় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিমা ক্ষেত্র বিদেশি সংস্থার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন মনমোহন সিংহ। কিন্তু তীব্র বিরোধিতা করেছিল বিজেপি। মোদী ক্ষমতায় আসার পরে দীর্ঘদিন সংসদে পড়ে থাকা বিমা বিল পাশ করাতে উদ্যোগী হন। বারাক ওবামা প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতে আসার আগেই তাঁর বিলটি পাশ করানোর ইচ্ছা ছিল। তখন আবার বিজেপি-কে উচিত শিক্ষা দিতে বেঁকে বসে কংগ্রেস। সংস্কারের জেদ দেখাতে অধ্যাদেশ পাশ করেন মোদী।
কিন্তু বিরোধীদের সাহায্য ছাড়া পাকাপাকি ভাবে বিমা আইন তৈরি করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং আলোচনা শুরু হয় কংগ্রেসের সঙ্গে। এখন প্রশ্ন হল, কংগ্রেস রাজি হল কেন? দলীয় সূত্রে বলা হচ্ছে, বিমা বিল পাশ করানোর ব্যাপারে কংগ্রেস নেতারাই চাপ দিচ্ছিলেন সনিয়া গাঁধীর উপরে। এঁদের মধ্যে ছিলেন রাজ্যসভায় কংগ্রেসের উপ দলনেতা আনন্দ শর্মা, দিগ্বিজয় সিংহ, অশ্বিনী কুমার প্রমুখ। তাঁদের বক্তব্য, যে হেতু কংগ্রেস আমলেই বিল পেশ হয়েছিল, তাই নীতিগত ভাবে এর বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া কংগ্রেস যখন দেখে যে, এডিএমকে, এনসিপি, বিজেডির মতো দলকে রাজি করিয়ে ফেলেছেন বিজেপি নেতৃত্ব, তখন তারা আর এর বিরোধিতা করে শিল্পমহলের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নিতে চায়নি।
বিলের পক্ষে ভোট না দিলেও আজ ওয়াক আউট করে কার্যত সরকারের সুবিধাই করে দিয়েছে তৃণমূল। মোদী-মমতা বৈঠকের পরে যে ঘটনাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন রাজধানীর রাজনীতিকরা। তৃণমূলের এই বদলে যাওয়া অবস্থান নিয়ে তাদের তীব্র কটাক্ষ করেছে বামেরা। তৃণমূল মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের অবশ্য ব্যাখ্যা, “বিমা বিলে সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে কংগ্রেস। তাই সরকারের হারার কোনও প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু যে ভাবে দু’দলের মধ্যে আঁতাঁত হয়েছে, তার প্রতিবাদেই ওয়াক আউট করার সিদ্ধান্ত নেয় তৃণমূল।”
সাধারণ বিমা ব্যবসা জাতীয়করণ আইন ও বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইনে সংশোধনের জেরে বিমায় প্রত্যক্ষ লগ্নির হার বর্তমানের তুলনায় আরও ২৩ শতাংশ বাড়বে। উপদেষ্টা সংস্থা কেপিএমজি-র হিসেব অনুযায়ী, তাতে জীবন বিমা, স্বাস্থ্য বিমা ও সাধারণ বিমা ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বিদেশি পুঁজি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু জীবন বিমাতেই প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে। সরকারের অবশ্য আশা, বিদেশি লগ্নি আসবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার। তা ছাড়া, সামগ্রিক ভাবে দেশের বিনিয়োগের ছবি ও ভাবমূর্তির বদল হবে বলেও শিল্পমহলে আশার সঞ্চার হয়েছে। তাদের মতে, অর্থনীতির জন্য আজকের দিনটি খুবই ইতিবাচক। মোদী জমানায় এই প্রথম কোনও সংস্কার কর্মসূচি যে সংসদের শিলমোহর পেল তা-ই নয়, দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় শুরু হওয়া নীতিপঙ্গুতার অবসানেও একটা মাইলফলক তৈরি হল আজ। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথায়, “কত মিলিয়ন ডলার আসবে, তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ মোদী সরকার যে শুধুই কথা বলে না, সংস্কার করে দেখাতে পারে, সেটা প্রমাণ হল।”
কিন্তু শিল্প মহলের আরও বড় দাবি জমি বিলের কী হবে?
কংগ্রেস ও তৃণমূল সূত্র বলছে, এই বিল তারা যে সমর্থন করবে না, সেটা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সরকারকে। জমি বিল সংসদীয় সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হবে, এই শর্তেই বিমা বিলে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ডেরেকের হুমকি, বিমা বিল উতরে গেলেও রাজ্যসভায় জমি বিল পাশ করানো মোটেই সহজ হবে না। বিরোধী দলগুলিকে একজোট করার
কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু আগামী সপ্তাহের শুরুতে জমি বিলের প্রতিবাদে সংসদ ভবন থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত পদযাত্রার যে পরিকল্পনা বিরোধী দলগুলি নিয়েছে, তাতে ব্যক্তিগত ভাবে হাজির থাকবেন না বলে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে মিছিলে সামিল হওয়ার অনুরোধ করেছিলেন জেডিইউ নেতা শরদ যাদব। কিন্তু মমতার যুক্তি, ওই মিছিল সাংসদদের। তাই শুধু সাংসদদেরই থাকা উচিত।
তবে বিরোধীদের দাবি মেনে জমি বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হলেই যে কার্যত তাকে হিমঘরে ঠেলে দেওয়া হবে, এমনটা মানতে নারাজ সরকার পক্ষ। তাদের বক্তব্য, বিরোধীদের চাপে খনি বিল সিলেক্ট কমিটিতে গিয়েছে। কিন্তু রিপোর্ট দেওয়ার জন্য তাদের দশ দিনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেই রিপোর্ট এসে গেলে চলতি অধিবেশনেই খনি বিল পাশ করানো যাবে বলে সরকার আশাবাদী। বিজেপি নেতাদের মতে, জমি বিল যদি সিলেক্ট কমিটিতে যায়, সেটা মন্দের ভাল। বিরোধীরা গোলমাল করে রাজ্যসভায় বিল পেশ করতেই না দিতে পারত। কিন্তু এই সমঝোতায় বিলটা অন্তত নির্বিঘ্নে পেশ হবে। তার পর সময় বেঁধে সিলেক্ট কমিটির রিপোর্ট আসার পরে বিল যদি হেরেও যায়, তখন সংসদের যৌথ অধিবেশন ডেকে তা পাশ করানোর পথ খোলা থাকছে। “জমি বিল নিয়ে এক পা পিছুও যদি হটতে হয়, কিন্তু বিমা বিল নিয়ে দু’কদম এগনো তো গেল!” মন্তব্য এক বিজেপি নেতার।
বিমা বিল পাশের ফলে শিল্প মহলে যে খুশির হাওয়া তা-ও বিজেপির পক্ষে যাবে। বণিক সংগঠন সিআইআই এবং ফিকি-র তরফে আজ বলা হয়, বিমায় যে পুঁজির অভাব ছিল এ বার তা মিটবে। নানা রকমের বিমা প্রকল্প বাজারে আসবে এবং আরও বেশি মানুষ বিমার আওতায় আসবেন। তা ছাড়া পরিকাঠামোয় বিনিয়োগের অভাবও অনেকটা কাটবে। ফলে আজ যা হল, তার সবটাই ইতিবাচক।