তরজাই সার। দেশের আর্থিক সংস্কার সেই রাজনৈতিক বিরোধিতার পাঁকে। সংসদের বাদল অধিবেশন কংগ্রেস ভন্ডুল করে দেওয়ায়, তীরে এসেও তরী ডুবেছিল পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) বিলের। তবু আশা ছিল, বিশেষ অধিবেশন ডেকে যদি তা পাশ করানো যায়। কিন্তু এখনও কংগ্রেসের যা মতিগতি, তাতে বিশেষ অধিবেশন ডাকলেও হৈ-হট্টগোল ছাড়া কাজের কাজ যে কিছু হবে না সেটা এখন সরকারের কাছে স্পষ্ট। অগত্যা বিশেষ অধিবেশন ডাকার আশা ছেড়ে সংসদের বাদল অধিবেশন মুলতুবির সিদ্ধান্ত নিতে হল সরকারকে। ২০১৬-র এপ্রিল থেকে জিএসটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেল আরও।
দেশের বড় শিল্পপতিরা গত কালই জমি অধিগ্রহণ থেকে জিএসটি-র মতো গুরুত্বপূর্ণ বিল আটকে থাকা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে। রাজ্যগুলির মাধ্যমে আর্থিক সংস্কারের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কি না, সেই পথ খুঁজতে বলেছেন সরকারকে। অথচ সে দিনই কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী যে ভাবে মোদীর যাবতীয় ঘোষণাকে ‘হাওয়াবাজি’ আখ্যা দিয়ে আক্রমণ শানিয়েছেন, তার পরে আর জিএসটি বিল নিয়ে সংসদের পথে বাড়তি হেঁটে লাভ হবে না, বুঝতে পারছে সরকার।
বিল পাশের আশায় এই ক’দিন বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল সরকার। কংগ্রেস বাদে আর
সব দলই বিলটির পক্ষে। কিন্তু কংগ্রেসের সংসদীয় নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হলেও সনিয়া বা রাহুল গাঁধীর সঙ্গে কোনও আলোচনাই করতে পারেননি মন্ত্রীরা। এই পরিস্থিতিতে আজ মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অরুণ জেটলি কংগ্রেসের ঘাড়েই গোটা দায় চাপিয়ে ঘোষণা করেন, রাষ্ট্রপতির কাছে সংসদ মুলতুবির সুপারিশ করা হবে। যার অর্থ, জিএসটি আপাতত স্রেফ বিজেপি-কংগ্রেসের তরজার বিষয় হয়েই থেকে যাচ্ছে।
তরজা কী নিয়ে?
বিলের শর্ত নিয়ে। কংগ্রেসের বক্তব্য, বিলটিতে কিছু সংশোধনের দাবি রাখা হয়েছিল। সেগুলি মেনে নিলেই কংগ্রেস সমর্থন করত। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জেটলির অভিযোগ, কংগ্রেস এখন যে সব শর্ত চাপাচ্ছে, সেগুলি তাদের সময়ে আনা বিলেও ছিল না। সংবিধানে করের হার বা উর্ধ্বসীমা বেধে দেওয়ার মতো দাবি মানা যায় না। জেটলির কথায়, ‘‘বিরোধী দলে গিয়ে কংগ্রেসে এখন নতুন ভাবনার উদয়
হয়েছে। নিজেরাই এই বিল এনেছিল। এখন তারাই বিরোধিতা করেছে।’’
জেটলির দাবি, কংগ্রেস আসলে বদলা নিচ্ছে। শুধু ভারত সরকারের বিরুদ্ধে নয়, ভারতবাসীর বিরুদ্ধেও। কারণ, ভারতবাসীই তাদের ৪৪-এ (লোকসভায় কংগ্রেসের সাংসদ- সংখ্যা) নামিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব জুড়ে মন্দার সময় ‘রাষ্ট্রনায়কের মতো ভূমিকা’ নিতে পারত কংগ্রেস। সে পথে তারা হাঁটছে না।
কিন্তু রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ আজ বুঝিয়ে দেন, বাস্তবেই বদলা নিচ্ছে কংগ্রেস। বিজেপির অতীত বিরোধিতার। গুলাম নবির কথায়, ‘‘জেটলি ভুলে গিয়েছেন, কংগ্রেসই বিলটি তৈরি করেছিল। তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা জেটলিরাই এই বিলের বিরোধিতা করেছিলেন।’’ আজাদের পরামর্শ, ‘‘এখন যে ভাবে আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, অরুণ জেটলির উচিত টেলিভিশনে না বসে নর্থ ব্লকে আরও বেশি সময় দেওয়া।’’
এই তরজার মধ্যে সরকারের হাতে বিকল্প পথ কী?
শিল্পপতিরা গত কাল রাজ্যগুলির মাধ্যমে সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে সেটা তা-ও করা সম্ভব, জিএসটি-র ক্ষেত্রে নয়। এই কর ব্যবস্থা চালু করতে সংবিধান পাল্টাতে হবে। এর জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন। তার উপরে অর্ধেক রাজ্যের বিধানসভাতেও তা পাশ করাতে হবে। তার পর কেন্দ্রে আরও দুটি বিল ও রাজ্যে আরও একটি বিল পাশ করাতে হবে। এই গোটা প্রক্রিয়া পূরণ হলে তবেই চালু হবে জিএসটি।
সরকার অবশ্য হাল ছাড়ছে না। জেটলি কবুল করছেন, আগামী ১ এপ্রিল থেকে জিএসটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার এ-ও বলছেন যে, ‘‘এখনও আলোচনার পথ খোলা আছে। যদি কোনও আশার আলো দেখা যায়, তা হলে যে কোনও সময় সংসদের অধিবেশন ডাকতে সরকার প্রস্তুত।’’ তবে বিজেপি নেতৃত্ব এটা বুঝতে পারছেন, কংগ্রেস এখন নিজেদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ফেরাতে মরিয়া। মোদী সরকারকে সব দিক দিয়ে হেয় করার লক্ষ্যে সংস্কারের পথ আটকে দাঁড়াতেও দ্বিধা করছে না সনিয়া-রাহুল। আগামী শীতকালীন অধিবেশনে যে তাঁরা এই পথ থেকে সরে আসবেন, এমন আশা করতে পারছে না সরকার। বিজেপির ভরসা একটাই, যদি বিহার নির্বাচনে জিতে কংগ্রেসের মনোবল আরও ভেঙে দেওয়া যায়।