বিধানসভা ভোটে খারাপ ফলের পরেই কংগ্রেসের অন্দরমহলে নতুন করে দাবি উঠেছিল, এ বার রাহুল গাঁধী সভাপতির দায়িত্ব নিন। দিগ্বিজয় সিংহের মতো নেতারা দলের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনের কথাও বলতে শুরু করেছিলেন। এই ডামাডোলের মধ্যেই সনিয়া গাঁধী কংগ্রেসের কিছু নেতাকে জানিয়ে দিলেন, খুব শীঘ্রই তিনি ‘নতুন প্রজন্ম’-র হাতে ব্যাটন তুলে দিতে চান।
রাহুল যে কংগ্রেস সভাপতি হবেন, তা নিয়ে দলের কারও মনে কোনও প্রশ্ন নেই। বরঞ্চ গত লোকসভা ভোটের পর থেকে অনেকেই বলছিলেন, অভিষেকের সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে করতে আসলে রাহুলের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’-রই ধার কমছে। তা ছাড়া এখন সনিয়া ও রাহুলকে নিয়ে দলে দু’টি ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। তিন বছর আগে রাহুল সহ-সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই সমস্যা আরও বেড়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, কবে রাহুল সভাপতি হবেন?
কংগ্রেস সূত্রের খবর, জুন মাসেই হিমাচল প্রদেশ বা উত্তরাখণ্ডে কংগ্রেসের চিন্তন শিবির বসবে। কংগ্রেস শাসিত কর্নাটকেও চিন্তন শিবির করার একটি ভাবনা রয়েছে। যেখানেই হোক, কংগ্রেস নেতারা চাইছেন, ওই শিবির থেকেই রাহুলের সভাপতি পদে অভিষেকের ঘোষণা করে দেওয়া হোক। সামনেই উত্তরপ্রদেশের ভোট। সভাপতি হিসেবেই সেই যুদ্ধে নামুন রাহুল।
ইঙ্গিত মিলেছে, এ বার সনিয়াও তা চাইছেন। দলনেত্রীর এই ইচ্ছের কথা প্রকাশ্যে এনেছেন পঞ্জাবের কংগ্রেস নেতা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘উনি অন্য কারও হাতে ব্যাটন তুলে দিতে আগ্রহী। এটা ওঁর সিদ্ধান্ত। দল সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের উচিত তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো।’’ অমরিন্দরের অবশ্য দাবি, এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সরাসরি সনিয়ার কথা হয়নি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘উনি সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বলেননি। কিন্তু আমরা যা জানতে পারছি, সবাই যে কথা বলছে, উনি নিজেও এখন সেটা বুঝতে পারছেন যে নতুন প্রজন্মের সময় এসে গিয়েছে। ভারতের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের নীচে। উনিও তা জানেন। গত ২০ বছর উনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এ বার উনি নিজেই সরে দাঁড়াতে চাইলে আমাদেরও সেই ইচ্ছেকে সম্মান জানানো উচিত।’’
উত্তরপ্রদেশের ভোটে প্রচার ও রণকৌশলের দায়িত্ব পেয়ে প্রশান্ত কিশোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন, রাহুল নিজে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হোন। রাহুলকে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসাতে ইচ্ছুক কংগ্রেস নেতাদের স্বাভাবিক ভাবেই সেই প্রস্তাব মনে ধরেনি। রাহুল না হলে প্রিয়ঙ্কা বঢরাকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। কিন্তু গাঁধী পরিবার একসঙ্গে দু’টি তুরুপের তাস কাজে লাগাতে রাজি নয়। অমরিন্দরের বক্তব্য, ‘‘রাহুল দায়িত্ব নিলেও প্রিয়ঙ্কা দলের সম্পদ হিসেবে থাকবেন।’’
কিন্তু রাহুল দায়িত্ব নিলেও কি কংগ্রেসের সব রোগ দূর হয়ে যাবে? কংগ্রেসের নেতাদের যুক্তি, তা আশা করা উচিতও নয়। কিন্তু দলীয় সংগঠনে একটা ঝাঁকুনি দেওয়া যাবে। রাহুলের সভাপতি পদে দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনের বড়সড় রদবদল অবশ্যম্ভাবী। তরুণ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসা হবে। বিজেপি কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের কথা বলতে শুরু করেছে। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে মাত্র ৪৪টি আসন জিতে কংগ্রেস এ যাবৎ সব থেকে খারাপ ফল করেছে। সম্প্রতি অসম-কেরল সমেত যে চারটি রাজ্যে ভোট হয়েছে, সেখানেও কংগ্রেসের ফল কহতব্য নয়। এই অবস্থায় সংগঠনে ঝাঁকুনি দেওয়াটা জরুরি। কারণ উত্তরপ্রদেশ ছাড়াও আগামী বছর গুজরাত, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল, মণিপুরেও বিধানসভা ভোট রয়েছে।
রাহুল ঘনিষ্ঠ নেতারা চাইছেন, এ মাসের চিন্তন শিবিরের আগেই সাংগঠনিক রদবদলের নীল নকশা তৈরি করে ফেলতে। এর আগে শেষ চিন্তন শিবির বসেছিল ২০১৩-য় জয়পুরে। সেখানেই সহ-সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে রাহুলকে লোকসভা ভোটে দলের মুখ করার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়। সেই লোকসভায় ভরাডুবির বৈঠকের পর এ বারেই প্রথম চিন্তন শিবিরের ডাক দিচ্ছে কংগ্রেস। এর আগে ২০০৩-এ সনিয়া গাঁধী শিমলায় কংগ্রেসের চিন্তন শিবিরের ডাক দিয়েছিলেন। সেখানেই অন্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে মিলে জোট সরকারের ভাবনা তৈরি হয়। পরের বছর বাজপেয়ী সরকারকে হঠিয়ে ইউপিএ-সরকার ক্ষমতায় আসে। এখন সেই ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি কংগ্রেসের এলাকাতেই থাবা বসিয়েছে। কোণঠাসা হয়ে পড়ছে কংগ্রেস। কমতে কমতে গোটা দেশে মাত্র ছ’টি রাজ্যে ক্ষমতায় টিকে রয়েছে কংগ্রেস। রাহুলকে শীর্ষপদে বসানোর পরিকল্পনা শুনে বিজেপির শাহনওয়াজ হুসেন কটাক্ষ করেছেন, ‘‘এতে কংগ্রেস-মুক্ত ভারত তৈরি কার কাজ আরও সহজই হবে।’’