এমন ফুলটস বল কেউ ছাড়ে!
সরাসরি সুষমা-বসুন্ধরার কুকীর্তি নিয়ে মন্তব্য না করলেও, রাজধর্মে নৈতিকতার গুরুত্ব বোঝাতে গতকাল নিজের ইস্তফার প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। এও বোঝাতে চেয়েছিলেন, মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতাকে রক্ষা করাই রাজনীতিকের অন্যতম দায়িত্ব! বিজেপি-র বর্ষীয়াণ নেতার এই খোঁচাকেই আজ বারুদের গোলা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কোর্টে ঠেলে দিতে চাইল কংগ্রেস। আর তার মাধ্যমে সুষমা-বসুন্ধরার ইস্তফার জন্য আরও এক দাগ চাপ বাড়াতে চাইল মোদীর ওপর। কংগ্রেসের বক্তব্য, বিরোধীদের কথা না হোক, দলের গুরুজনদের কথা অন্তত শুনুক মোদী! নইলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয়ের অভিযোগে এবার তাঁর বিরুদ্ধে ইস্তফা দাবি উঠবে সংসদের ভিতরে-বাইরে।
গতকাল আনন্দবাজারকে এক বিশেষ সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন বিজেপি-র একদা লৌহ পুরুষ লালকৃষ্ণ আডবাণী। দু’দশক আগে জৈন হাওয়ালা কাণ্ডে তাঁর ইস্তফার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে তিনি অকপটে মত প্রকাশ করেন। বলেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতার জীবনে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করাই সবথেকে বড় ধর্ম। নৈতিকতা কী দাবি করছে সেটাই রাজধর্ম।’’ যদিও ললিতকাণ্ডে বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বা রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের ইস্তফা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁর কথায়, ‘‘সেদিন বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েই ইস্তফা দিয়েছিলাম। বাজপেয়ীজির কথাও শুনিনি। আমি কেবল আমার কথাটাই বলতে পারি। অন্যরা কী করবেন, কার কী বিষয়, কার কী সমস্যা এ সব আমি জানি না। আর এ সব বিষয়ে কোনও মন্তব্যও করব না।’’
আডবাণীর এই সাক্ষাত্কার নিয়ে গতকাল রাত থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে সাড়া পড়ে গেছে। তোলপাড় শুরু হয়েছে বিজেপি-র অন্দরেও। এমনকি বিজেপি-র অনেক নেতা ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করছেন, তাঁদের মনের কথা বলেছেন আডবাণী। বিরোধীরাও স্বাভাবিক ভাবে সাম্প্রতিকের প্রেক্ষাপটেই জৈন হাওয়ালা কাণ্ডে আডবাণীর ইস্তফার ইতিহাসকে দেখছেন। তাই যে আডবাণীকে সাম্প্রদায়িক, ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংসের’ নায়ক বলে কংগ্রেস বরাবর সমালোচনা করত, আজ তাঁকে ‘‘উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন, বিবেচক রাজনীতিক বলে কাছে টেনে নিতে দেরি করেননি কংগ্রেস নেতারা। রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, ‘‘আডবাণী কোনও ইশারা-ইঙ্গিত দেননি। তিনি স্পষ্ট ভাষায় নরেন্দ্র মোদীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সুষমা-বসুন্ধরাকে এখনই তাঁদের পদ থেকে সরানো উচিত। সেটাই নৈতিকতার দাবি।’’
কিন্তু প্রশ্ন হল, নরেন্দ্র মোদী যদি আডবাণীর কথাও না শোনেন? জবাবে গুলাম নবি বলেন, ‘‘এসব ব্যাপারে মোদী বরাবরই অবাধ্য জানি। দলের গুরুজনদের কথাও যে তিনি শোনেন না তার নজিরও রয়েছে। গুজরাত দাঙ্গার পর তাঁকে রাজধর্ম স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তিনি শোনেননি। ওই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে এখনও ক্ষমাও চাননি। এখন আডবাণীর রাজধর্মের পাঠও তিনি নাও শুনতে পারেন। কারণ, বিজেপি-তে তাঁর কাছের নেতারা ইদানিং বলতে শুরু করেছেন, যে সব নেতার ৭৫ বছরের বেশি বয়স হয়েছে, তাঁদের মস্তিষ্ক কাজ করছে না বলে ধরে নেওয়াই ভাল!’’ তবে এই টিপ্পনির পাশাপাশি মোদীকে কার্যত হুঁশিয়ার করে রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘সুষমা ও বসুন্ধরার ইস্তফা প্রধানমন্ত্রীর হিতের জন্যই জরুরি। নইলে সংসদে তাঁর ইস্তফার দাবিও অচিরে উঠবে।’’
ইস্তফা নিতে প্রধানমন্ত্রী অনড় থাকলে কংগ্রেস ভবিষ্যতে যে আইনি পথে হাঁটতে পারে সেই হুমকিও আজ দেন গুলাম নবি। তিনি বলেন, ‘‘এই সরকারে এখন অবস্থা যে চোর, সেই বিচারক। কিন্তু দেশ থেকে এখনও উচ্চ আদালত বা সর্বোচ্চ আদালত যে উঠে যায়নি তা হয়তো ওঁরা ভুলে গেছেন। একজন পলাতক অভিযুক্তকে যে ভাবে বিদেশ মন্ত্রী ও রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী সাহায্য করেছেন তা সাদা কালোয় ফৌজদারি অপরাধ। সুতরাং পালানোর পথ নেই।’’
সন্দেহ নেই আডবাণীকে নিয়ে কংগ্রেস নেতারা আজ খুবই খুশি। জরুরি অবস্থা নিয়ে মোদীকে প্রকারান্তরে খোঁচা দিয়ে কদিন আগেও বিরোধীদের হাত অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন এই বর্ষীয়াণ নেতা। কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, মোদী-জেটলি-অমিত শাহদের কৌশলটা একেবারেই পরিষ্কার। সুষমা ও বসুন্ধরার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ওঁরা আপাতত ঘাপটি মেরে থাকতে চাইছেন। অপেক্ষা করছেন, যাতে বিষয়টা আপনা থেকে থিতু হয়ে যায়। কারণ, ওঁরা ভাবছেন একই ভাঙা রেকর্ড বিরোধীদের পক্ষে বেশি দিন চালানো সম্ভব নয়। সুষমা-বসুন্ধরার সঙ্গে ললিত মোদীর যোগাযোগ নিয়ে রোজ নতুন তথ্য জোগাড় করাও বিরোধীদের পক্ষে মুশকিল। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা ক্রমশ ফিকে হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আডবাণীর গতকালের মন্তব্য বিতর্কটিকে শুধু জিইয়ে রাখতে সাহায্য করল না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও অস্বস্তিতে ফেলে দিল। কংগ্রেস নেতাদের আশা, আডবাণী এভাবে মুখ খোলার পর মুরলী মনোহর জোশী সহ বিজেপি-র আরও কিছু নেতাও ক্রমশ মুখ খুলবেন। এমনিতেই কীর্তি আজাদের মতো নেতারা দলের অস্বস্তি বাড়াতে শুরু করেছেন। ললিতকাণ্ড নিয়ে এভাবে বিজেপি-র মধ্যে কোন্দলটাও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ললিতকাণ্ডে আজ নতুন একটি বিতর্কও সামনে এসেছে। ললিত মোদীর পাসপোর্ট ও অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্য জানতে চেয়ে বিদেশমন্ত্রকের কাছে এক ব্যক্তি তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু বিদেশমন্ত্রক সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। আজ তা নিয়েও সরকারের সমালোচনা করেন কংগ্রেস নেতারা। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা দিগ্বিজয় সিংহ বলেন, ‘‘সরকারের কুকীর্তি যাতে ফাঁস না হয়ে যায় সেজন্যই মোদী তথ্য কমিশনকে অকেজো করে রাখতে চেয়েছিলেন। এটা আগে সন্দেহ ছিল, এখন বোঝা যাচ্ছে সেটাই আসল কারণ। সনিয়া গাঁধী সংসদে সরব না হলে মুখ্য তথ্য কমিশনার নিয়োগ এত দিনেও হত না।’’ তাঁর কথায়, তবে আর তথ্য লুকিয়েও লাভ নেই! যা তথ্য ফাঁস হয়েছে, সুষমা-বসুন্ধরার ইস্তফার জন্য এতটা যথেষ্ট। আসল কথা হল, ওঁরা ইস্তফা দিক। নইলে কংগ্রেস জানে কী ভাবে ইস্তফা আদায় করতে হয়!