ফিরল চিরকুট লেখা, বাড়ি এসে খোঁজখবর

৩ মে ভুলবে না ওড়িশাবাসী। কিন্তু সেদিন প্রকৃতির অদ্ভুত আক্রামক, উদ্দাম, অর্থহীন কাণ্ডকারখানা দেখার সময়ে ছিল এক রকমের উত্তেজনা-ও। উত্তেজনা, কে না জানে যে, শেষ হয় অবসাদে। 

Advertisement

যশোধরা রায়চৌধুরী (ভুবনেশ্বর থেকে)

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৯ ০২:০৭
Share:

যেদিন ঝড়, সেদিন তো দুর্যোগ। দুর্যোগ শেষ হলে আসে দুর্ভোগ। দুর্যোগ সহজে শেষ হয়, কিন্তু দুর্ভোগ অত দ্রুত শেষ হয়না। দীর্ঘদিন যুঝতে হয় তার সঙ্গে।

Advertisement

৩ মে ভুলবে না ওড়িশাবাসী। কিন্তু সেদিন প্রকৃতির অদ্ভুত আক্রামক, উদ্দাম, অর্থহীন কাণ্ডকারখানা দেখার সময়ে ছিল এক রকমের উত্তেজনা-ও। উত্তেজনা, কে না জানে যে, শেষ হয় অবসাদে। পরদিন সকালে দল বেঁধে এর ওর বাড়ি যাওয়া শুরু হল। সামাজিক বন্ধনের চেহারাটা বোঝা যায়, যখন ঝাঁকুনি খায় মোবাইল ফোন-হোয়াটসঅ্যাপ-নেট কানেক্টিভিটির আপাত সংযুক্ততার নিরাপত্তা বলয়৷

পরের দিন থেকে আমরা সত্তর দশকের মতো, সকাল-বিকেল বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা, চা, বিস্কুট, জল দিয়ে আপ্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে কুশলবিনিময়। কার বাড়ির কটা গাছ ভেঙেছে, কার বাড়ির চাল গেছে উড়ে। আমাদের ইস্তিরিওয়ালার ঘরের চালে গাছ পড়ে গেছে,
সে সবার বাড়ি থেকে আনা কাপড়ের আন্ডিল রাখল আমার গ্যারাজে। মালির ঘর ভেঙে গেছে, দুটি ছোট বাচ্চা নিয়ে সে আশ্রয় নিল এক সহকর্মীর আউট হাউজে।

Advertisement

শহরের পথে পা রেখেই দেখতে পেলাম শুধু বৃক্ষদের মৃতদেহ। সারা শহরে অন্তত এক লক্ষ গাছকে দলে মুচড়ে ভেঙে দিয়ে গেছে ফণী। অতি দ্রুত কাজে নেমেছে ওড়িশা ডিজাস্টার রিলিফ ফোর্স আর ন্যাশনাল ডিজাস্টার রিলিফ ফোর্স। তা ছাড়া দমকল বিভাগ, বিদ্যুৎ দফতর, পিডবলিউডি। রাজ্য সরকারকে সাধুবাদ দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ৷ ১০ লক্ষাধিক মানুষকে শেলটারে সরিয়েছেন অসংখ্য রাজ্য সরকারি কর্মী। হাতে-পায়ে ধরে রাজি করিয়েছেন ঘর ছাড়তে। আধার, রেশন কার্ড, বাকি সব জরুরি জিনিস নিয়ে সাইক্লোন শেলটারে আশ্রয় নিয়েছেন যাঁরা, ১৯৯৯ এর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এই সাইক্লোন প্রবণ রাজ্যটির কাছে তাঁরা ঋণী হলেন।

এবার দেখার, কীভাবে স্বাভাবিক জনজীবন ফেরাতে পারেন এই সরকার। খুব সহজ যে সেটা হওয়ার নয়, পথে পড়ে থাকা অসংখ্য ওপড়ানো বিজলিস্তম্ভ থেকেই তা মালুম।

পথে পথে ডিজেল চালিত করাত দিয়ে বড় বড় গাছ কেটে ফেলে রাস্তা পরিষ্কার করার দৃশ্য দুদিন কেবলই। বিজ্ঞাপনের ফ্লেক্স শুধু না, বিজ্ঞাপনের লোহার স্ট্যান্ড বা খাঁচা দুমড়েমুচড়ে আছে এ-দিকে ও-দিকে।

ইতিমধ্যেই কারেন্ট না থাকা জনিত সমস্যাগুলো গুঁড়ি মেরে এসেছে। জল তোলার পাম্প চলবে না বলে ৬০০ ঘরের কলোনিতে মারামারি লেগে যায় প্রায়। ডিজেল জেনারেটরের ব্যবস্থা করলেন আমাদের তরুণতর সহকর্মীরা, সারা ভুবনেশ্বর, কটকে ঘুরে। বড় ট্যাঙ্কে জল ভরে অটোভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে ঘরে ঘরে জল পৌঁছে দিলেন।

মানুষের মুখ বিপদকালে মানবিক হয়ে ওঠে আবার তেমন হলে স্বার্থপরতাও স্পষ্ট দেখা যায়। সব সামলে তরুণ কর্মীরা শেষমেশ জলের ব্যবস্থা পাকা করে ক্লান্ত দেহে এসে বসলেন যখন
আমার বাড়িতে, যেহেতু ততক্ষণে দেহ রেখেছে আমার ল্যান্ড লাইন ও দুটি সিমকার্ড, আমার উতলা ভাব বেড়ে গেছে প্রবলভাবে। কোনও মতে টেনে নিই কাগজ। চিরকুট লিখে পাঠাই আর এক সহকর্মীর বাড়ি। সকালে দেখে এসেছি তাঁর ল্যান্ডলাইন চালু আছে। তিনি আমার পরিবারকে ফোনে কুশল জানালেন এবং ফেরত চিরকুটে জানালেন সে সংবাদ।

বিজলিহীন তিন রাত ও চার দিন কেটে গেল এভাবেই। জল মেপে খরচ করছি। সোমবার রাত নটায় আমার এলাকায় বিজলি ফিরেছে। এখনও অন্ধকারে অনেক এলাকা।

(লেখিকা কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক। কবি ও প্রাবন্ধিক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন