সময় এক। জায়গাও এক। বছর গড়িয়ে একই ধাঁচে ফের ঘূর্ণিঝড় চোখ রাঙাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। পঞ্জিকার সৌজন্যে দুর্গাপুজো রেহাই পেয়ে গেল এক চুলের জন্য!
গত বার অবশ্য পায়নি। ২০১৩-র পুজোর ঠিক মুখে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের শেষাশেষি আন্দামান সাগরে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। যা আগামী দিন তিনেকের মধ্যে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ ধরে আছড়ে পড়ে অন্ধ্র-ওড়িশা উপকূলে। সেই ‘পিলিন’-এর বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল পুজোর কলকাতা। এ বার পুজো পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সাগরে ঝড়ের মরসুম শুরু হয়েছে যথাসময়ে, যথাস্থানে। ‘হুদহুদ’কে দিয়ে।
মঙ্গলবার বিকেলের উপগ্রহ-চিত্রে দেখা যাচ্ছে, পোর্ট ব্লেয়ারের আড়াইশো কিলোমিটার পূর্বে আন্দামান সাগরে একটি অতি গভীর নিম্নচাপ অবস্থান করছে। যার আশপাশের বায়ুপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে আবহবিদদের ধারণা, আজ, বুধবার সেটি তেজ বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নেবে। এবং বুধবারের বিকেলের মধ্যে আন্দামান উপকূল পেরিয়ে সরে আসবে পশ্চিম-উত্তর পশ্চিমে।
অর্থাৎ, ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য অভিমুখ অন্ধ্র-ওড়িশা উপকূল। পশ্চিমবঙ্গে কতটা প্রভাব পড়বে, এখনও বলা যাচ্ছে না। বস্তুত আবহবিদেরা এ-ও জানিয়ে রেখেছেন, এ দিন দুপুরে কলকাতায় বজ্র, বিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি, আর সেই ইস্তক আকাশের মুখ ভার করে থাকার সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে নির্মীয়মাণ ঘূূর্ণিঝড়ের কোনও সম্পর্ক নেই। ওঁদের ব্যাখ্যা: স্থানীয় বজ্রগর্ভ মেঘ শহরে ওই বৃষ্টি নামিয়েছে, যেমন মাঝে-মধ্যে নামিয়েছিল পুজোর দিনগুলোয়। আলিপুর আবহাওয়া অফিসের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথের কথায়, “বৃহস্পতি-শুক্রবারের মধ্যে ঝড়ের পরবর্তী গতিপথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। তখন প্রয়োজন হলে ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে সতর্ক-বার্তা জারি করব।”
বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের মরসুম মূলত দু’টো। একটা বর্ষার আগে, মে-জুন মাসে। অন্যটা বর্ষার পরে, অক্টোবর-নভেম্বরে। গত বছর মে-তে বঙ্গোপসাগরে প্রাক বর্ষার একটা ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলেও তা মায়ানমারে চলে যাওয়ায় গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে তেমন আঁচ পড়েনি। আর গত বছর বর্ষার পরে অক্টোবর-নভেম্বরে বঙ্গোপসাগরে যে চারটি ঘূর্ণিঝড় দানা বাঁধে, তার মধ্যে স্থলভূমিতে আঘাত করেছিল একমাত্র পিলিন। অন্য তিনটে (মাদি, লেহর ও হেলেন) ডাঙা ছোঁয়ার আগে সাগরেই বিলীন হয়ে গিয়েছে।
এ বছর বর্ষার আগে কোনও ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়নি। তবে পরবর্তী মরসুমের প্রথম ঘূর্ণিঝড়টি দানা পাকছে। সেই হিসেবে চলতি বছরে এটাই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রথম ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু বর্ষার আগে-পরে ঠিক এই দু’টো সময়েই কেন বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় মাথা তোলে?
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, সম্ভাব্য বিভিন্ন কারণের অন্যতম হল সাগরের জলতলের উষ্ণতা বৃদ্ধি। জলের তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ালে ঘূর্ণিঝড়ের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রাক বর্ষা ও বর্ষার বিদায়কালে বঙ্গোপসাগরে জলতলের তাপমাত্রা ওই গণ্ডি অতিক্রম করে যায়। গোকুলবাবুর ব্যাখ্যা, “সমুদ্র জলের তাপমাত্রার ওঠা-নামা অনেকটা নির্ভর করে সূর্যের গতিপথের উপরে। বর্ষার আগে সূর্যের উত্তরায়ণ ঘটে। অর্থাৎ, দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে সূর্য যাত্রা করে উত্তর গোলার্ধের দিকে। আবার বর্ষার পরে দক্ষিণায়ণ, মানে উত্তর গোলার্ধ থেকে সূর্য যায় দক্ষিণ গোলার্ধে। দু’টো সময়েই বঙ্গোপসাগরে জলের উষ্ণতা বেড়ে যায়।”
এরই সঙ্গে অন্যান্য কিছু বিশেষ প্রাকৃতিক পরিস্থিতি যুক্ত হলে উদ্ভব হয় ঘূর্ণিঝড়ের। আবহবিদদের বক্তব্য, এ বার বর্ষার আগে সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়লেও অন্যান্য পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। তাই তখন ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়নি। এখন অনুকূল পরিস্থিতি পেয়ে তা নির্দিষ্ট আকার নিচ্ছে।
আর তালিকা মেনে নির্মীয়মাণ ঝড়টির নামকরণও ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে। একে ‘হুদহুদ’ বলে ডাকা হচ্ছে। নামটি ওমানের দেওয়া। হুদহুদ বলতে বোঝায় একটি পাখিকে, প্রাচীন উপকথা অনুযায়ী যে কিনা সুলতানের দরবারে বার্তাবাহী চিঠি নিয়ে আসত। প্রসঙ্গত, উত্তর ভারত মহাসাগর অঞ্চলের (আরবসাগর, বঙ্গোপসাগর-সহ) যে আটটি দেশে (ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, তাইল্যান্ড, ওমান, মলদ্বীপ) সাধারণত সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে, তারা মিলে ঝড়ের একটা নাম-তালিকা বানিয়েছে। তাতে প্রতিটা দেশ নিজের মতো নাম দিয়েছে। ২০১২ সাল থেকে সেই তালিকা ধরে ধরে নামকরণ হয়েছে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের সিডার, আয়লা, পিলিন, লেহর, মাদি ইত্যাদি।
নতুন ঝড়ের নামকরণ এই প্রক্রিয়াতেই। শুধু তা-ই নয়, আগামী ২৮টি ঘূর্ণিঝড়ের নাম কী হবে, তা-ও ঠিক হয়ে রয়েছে। তালিকার সব নাম ফুরিয়ে গেলে আট দেশ ফের বৈঠকে বসবে। নতুন তালিকা বানাতে।