বিস্ফোরণ স্থলে চুরমার পুলিশের গাড়ি। বৃহস্পতিবার পার্থ চক্রবর্তীর তোলা ছবি।
হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা, ঠোটের কোণে ক্ষত, কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে। তবু তার মধ্যেই গত কালের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন সমরুদ্দিন আনসারি। রাঁচির বরিয়াতু এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের জেনারেল বেডে শুয়েছিলেন ওরা তিনজন। সমরুদ্দিন, নীরজ পাণ্ডে ও প্রবীণ মিশ্র। এঁদের আঘাত তুলনামূলক ভাবে কিছুটা কম বলে তাঁদের রাখা হয়েছে জেনারেল বেডে। বাকিদের মধ্যে দু’জন রয়েছেন হাইলি ডিপেন্ডেবেল ইউনিট (এইচডিএউ) ও একজন নিউরো ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে।
সমরুদ্দিন জানালেন, কালাপাহাড়িতে তল্লাশি অভিযান সেরে তাঁরা ফিরছিলেন ছতরপুরের শিবিরে। ভাড়া করা গাড়ির পিছনে বসেছিলেন তিনি এবং তাঁর দুই সঙ্গী, প্রবীণ ও নীরজ। তখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ছ’টা। দু’পাশে খেত, মাঝের সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে জোরে। চারপাশ বেশ অন্ধকার। হঠাৎ কান ফাটানো একটা আওয়াজ। সমরুদ্দিন বলেন, “মনে হল যেন প্রবল একটা ঘুর্ণিঝড়ে গোটা গাড়িটাই কয়েক ফুট উপরে উঠে গেল। আর আমি ওই গাড়ির ছাদের ত্রিপল ফুঁড়ে উড়ে গিয়ে পড়লাম কয়েক ফুট দূরে। তার পরের কিছুক্ষণের কথা মনে নেই।”
সমরুদ্দিন একা নয়, গাড়ির ছাদের ত্রিপল ছিঁড়ে ছিটকে পড়েন প্রবীণ ও নীরজও। কোনও রকমে নীরজ বলেন, “আমি ছাদের ত্রিপল ফুঁড়ে ছিটকে পড়লেও জ্ঞান হারাইনি। কব্জিটা যেন যন্ত্রনায় ছিড়ে যাচ্ছে। সেই অবস্থাতেই বুঝতে পারলাম মাওবাদী হানা হয়েছে। কারণ একটু দূরে গুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। ওই অবস্থাতেই আমি ও আমার পাশে ছিটকে পড়া প্রবীণ পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করি। এই ভাবে মিনিট দশেক কাটে। তার পর সিআরপিএফ এর একটা ভ্যান দেখতে পাই। হেল্প হেল্প করে চিৎকার করতে ওরা আমাদের কাছে চলে আসে। সিআরপিএফও পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করলে ওরা পালায়।”
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময় দুমকার শিকারিপাড়ায় মাওবাদী হানায় ছ’জন পুলিশ কর্মী নিহত হন। গাড়ির চালক বাদে ছয় পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ড পুলিশ বারবার দাবি করেছিল, মাওবাদীদের মনোবল তাঁরা ভেঙে দিতে পেরেছেন। এরিয়া কম্যান্ডাররা গ্রেফতার হয়েছে। অনেকে আত্মসমর্পণও করেছে। অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করায় গত কয়েক বছরে মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশের জখম হওয়ার ঘটনা কার্যত ঘটেনি। তবে গত কালের ঘটনায় প্রশ্ন উঠল ঝাড়খণ্ড পুলিশ সত্যিই কতটা সতর্ক ছিল? তিন দিন ধরে ওই এলাকায় তল্লাশি অভিযান চলছিল। এরই মধ্যে একটি মোবাইল টাওয়ারও মাওবাদীরা উড়িয়ে দেয়। পুলিশ সূত্রে জানিয়েছে, কাল বিকেলে ছতরপুর থানায় কোনও গ্রামবাসী ফোনে জানায়, কালাপাহাড়ির জঙ্গলে এক মাওবাদীর দেহ দেখতে পাওয়া গিয়েছে। সেটা দেখতেই পুলিশের ওই দলটি একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দেয়।
পুলিশের এক অংশের মতে, এটা মাওবাদীর ফাঁদ পাতার পুরনো ছক। এই ফাঁদে পুলিশ কেন এত সহজে পা দিল? কেন অতিরিক্ত সতর্কতা না নিয়ে মাওবাদীদের ডেরা, কালাপাহাড়ির দিকে রওনা দিল পুলিশ? কেন তারা অ্যান্টি-ল্যান্ডমাইন গাড়ি না দিয়ে একটা সাধারণ গাড়িতে রওনা দিল?
আজ সকালেই ঝাড়খণ্ড পুলিশের ডিজিপি ডি কে পাণ্ডে, এডিজি (অপারেশন) এস এন প্রধান-সহ পুলিশকর্তারা ঘটনাস্থলে রওনা দিয়েছেন। ডিজিপি বলেন, “গত কালের ঘটনায় পুলিশের কোনও অস্ত্র লুঠ হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে বিহার-সীমা খুব কাছে। পলামুর সঙ্গে বিহারের সীমা সিল করে দেওয়া হয়েছে।” অন্য দিকে, প্রধান বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, এই ঘটনার পিছনে মাওবাদী নেতা নীতীশ, অজয় ও মিথিলেশরা রয়েছে। তল্লাশি অভিযান আরও জোরদার করা হবে।” পুলিশকর্তাদের দাবি, ঘটনার পর খুব দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধার কাজ করা হয়েছে। না হলে মৃতের সংখ্যা হয়তো বাড়ত। প্রধান বলেন, “উদ্ধার কাজে এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার এম আই ১৭ ব্যবহার করায় আমরা আহতদের দ্রুত রাঁচিতে আনতে পেরেছি।”