Misuse of Walkie-Talkies

অ-ভিআইপি নেতাদের ‘গুরুত্ব’ বৃদ্ধির যন্ত্র জঙ্গিদের কাজ সহজ করেছে কি? পহেলগাঁও-কাণ্ডের পরে কড়া নজর ওয়াকিটকিতে!

পহেলগাঁও হামলার পরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে অনুমোদনহীন ওয়াকিটকি হ্যান্ডসেটের উপরে। কারা ব্যবহার করছেন, তা দেখতে হানা দেওয়াও শুরু করেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপে অনেক রাজনৈতিক নেতা সমস্যায় পড়তে পারেন।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২৫ ০৯:০১
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

কেউ ব্যবহার করছিলেন ‘ভিআইপি’ সাজতে। কেউ ব্যবহার করছিলেন ব্যবসা বাড়াতে। কেউ ‘গোপন রাজনৈতিক অভিযানে’র ঘুঁটি সাজাতে। কেউ আবার ব্রিগেডের কর্মসূচির ব্যবস্থাপনা ‘মসৃণ’ রাখতে। কিন্তু অনেকের অজান্তেই লাইসেন্সবিহীন ওয়াকিটকির রমরমা সহজ করে দিচ্ছিল সন্ত্রাসবাদীদের কাজ। অনুমোদনহীন চিনা যন্ত্রের অবাধ কেনাবেচা মসৃণ করছিল নাশকতার পথ। লাইসেন্সধারী উপভোক্তারা বিষয়টি আগেই জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। কিন্তু তখন কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।

Advertisement

কিন্তু পহেলগাঁও হামলার পরে পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে অনুমোদনহীন ওয়াকিটকি হ্যান্ডসেটের কেনাবেচার উপরে। লাইসেন্স ছাড়া কারা সে সব ব্যবহার করছেন, তা খতিয়ে দেখতে হানা দেওয়াও শুরু করেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের ফলে অনেক রাজনৈতিক নেতা সমস্যায় পড়তে পারেন। কারণ ‘ভিআইপি’ সাজতে অনেকেই ওয়াকিটকিধারী বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করেছিলেন নিজেদের জন্য।

কেন্দ্র যে এই ‘বেআইনি’ কার্যকলাপ নিয়ে বিচলিত, তা কেন্দ্রীয় উপভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রকের পদক্ষেপেই স্পষ্ট। অনলাইন কেনাবেচার অ্যাপভিত্তিক (ই-কমার্স) সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ওই সব বেআইনি হ্যান্ডসেটের বিক্রি অবিলম্বে বন্ধ করতে। টেলিযোগাযোগ বিভাগও খোলাবাজারে হানা দিয়ে বেআইনি হ্যান্ডসেট বাজেয়াপ্ত করার অভিযান শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় উপভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘অনুমোদনহীন ওয়্যারলেস যন্ত্র বিক্রি করা শুধু আইনি বাধ্যবাধ্যকতা লঙ্ঘন করছে না, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও তা গুরুতর বিপদ ডেকে আনতে পারে।’’

Advertisement

পহেলগাঁও হামলা হয়েছিল গত ২২ এপ্রিল। জোশী ওই পোস্ট করেন গত ৯মে। অর্থাৎ, পহেলগাঁও হামলার পরেই যে কেন্দ্রীয় সরকার এই সব বেআইনি ওয়াকিটকির বিপদ আরও বেশি করে টের পেয়েছে, সেই ইঙ্গিত মন্ত্রীর পোস্টে রয়েছে।

ওয়াকিটকির অনুমোদনহীন বিক্রি বন্ধে কেন্দ্র নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ইতিমধ্যেই যে সব ‘অবৈধ’ ব‍্যবহারকারীর কাছে তা রয়েছে, টেলিযোগাযোগ বিভাগ তাদের সকলকে চিহ্নিত করতে পারবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। অনেক ইভেন্ট ম‍্যানেজমেন্ট সংস্থা এবং বেসরকারি নিরাপত্তা পরিষেবা সংস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে লাইসেন্স ছাড়া কর্মীদের হাতে ওয়াকিটকি দেয়। জনপ্রতিনিধি নন বা সরকারি নিরাপত্তা পান না, এমন রাজনীতিকেরা সেই সব ওয়াকিটকিধারী, সাফারি পরিহিত নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়োগ করেন জনসমক্ষে নিজেদের ‘ভিআইপি’ হিসেবে তুলে ধরতে। এমন উদাহরণ এ রাজ্যে কম নেই। অধুনা এক তৃণমূল বিধায়ক কংগ্রেসে থাকাকালীন চোখে পড়ার তাগিদে চারপাশে ওয়াকিটকিধারী নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে ঘুরতে শুরু করেছিলেন। সাবেক তৃণমূল তথা বর্তমানে বিজেপির এক নেতাও কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা হারানোর পর থেকে মাঝেমধ্যেই বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী এবং ওয়াকিটকি ‘দেখিয়ে’ থাকেন। জঙ্গলমহলের এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রীর বাড়ি থেকে এক বার লাইসেন্সবিহীন হ‍্যান্ডসেট উদ্ধার হয়েছিল। দেশের অন‍্য অনেক প্রান্তেও এই প্রবণতা আছে। বিহারের এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে লাইসেন্স-বহির্ভূত ওয়াকিটকি ব‍্যবস্থার হদিস মিলেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়াকিটকি সংক্রান্ত সাম্প্রতিক পদক্ষেপে এই ধরনের নেতাদের বিপাকে পড়ার অবকাশ রয়েছে।

ওয়াকিটকি বা হ্যান্ডহেল্ড অয়্যারলেস সেট ব্যবহার করার জন্য নির্দিষ্ট লাইসেন্স নেওয়া জরুরি। পুলিশ, দমকল বা হ্যাম রেডিয়ো অপারেটর— কেউই লাইসেন্স ছাড়া ওয়াকিটকি ব্যবহার করে না। কিন্তু দুর্গম অঞ্চলে, বিশেষত পাহাড়ি এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা কিছুটা সহজ করার জন্য কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকার লাইসেন্স ছাড়াই সীমিত ক্ষমতার ওয়াকিটকি ব্যবহারের ছাড়পত্র দিয়েছিল। সেই ছাড়পত্রেরই দেশজোড়া ‘অপব্যবহার’ শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ। পহেলগাঁও হামলার ছক কষতে সেই ছাড়পত্রেরই সুযোগ নেওয়া হয়েছে কি না, তা-ও বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা খতিয়ে দেখছে।

‘ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবে’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস বলছেন, ‘‘প্রত্যেক উপভোক্তার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রক আলাদা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সি বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট করে দেয়। পুলিশের জন্য আলাদা, দমকলের জন্য আলাদা, হ্যাম রেডিয়োর জন্য আলাদা। যে যার নিজের ফ্রিকোয়েন্সিতে কথোপকথন চালায়। তাই এক সংস্থার বার্তালাপ অন্য সংস্থার ফ্রিকোয়েন্সিতে কখনও ঢোকে না।’’ লাইসেন্সবিহীন উপভোক্তাদের জন্য যে ‘স্পেকট্রাম’ সরকার বরাদ্দ করেছে, তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪৪৬.০ মেগাহার্ৎজ় থেকে ৪৪৬.২ মেগাহার্ৎজ় পর্যন্ত প্রশস্ত। পাহাড়ের যে সব দুর্গম এলাকায় সাধারণ ফোনের নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেট সে ভাবে কাজ করে না, সেই সব এলাকার কথা মাথায় রেখেই এই লাইসেন্সবিহীন রেডিয়ো যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শর্ত ছিল, এই ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে কথা বলার জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ মিলিওয়াট ক্ষমতার হ্যান্ডসেট ব্যবহার করা যাবে। কারণ, ওই হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে যোগাযোগ এক কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাই বড়সড় অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে না। শুরুতে সেই শর্ত মেনেই কাজ হচ্ছিল। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই অনুমোদিত ক্ষমতার হ্যান্ডসেটের আদলে অনেক উচ্চক্ষমতার হ্যান্ডসেট তৈরি করে বাজারে ছাড়া হয়েছে। ফলে নাশকতার ছক কষতে ওই সব হ্যান্ডসেট ব্যবহারের অবকাশ রয়ে গিয়েছে।

অম্বরীশ জানিয়েছেন, ওই সমস্ত হ্যান্ডসেট দেখতে একেবারেই ৫০০ মিলিওয়াট ক্ষমতার ওয়াকিটকির মতো। কিন্তু আসলে ৫ ওয়াট ক্ষমতার। অর্থাৎ, ১২-১৪ কিলোমিটার দূর পর্যন্তও কথোপকথন চালানো যায়। তাতে আবার ১৬টি ফ্রিকোয়েন্সিকে ধরে ফেলার ব্যবস্থা রয়েছে। হ্যাম রেডিয়োও ফ্রিকোয়েন্সি, পুলিশের ফ্রিকোয়েন্সি, সমস্তই ওই সব হ্যান্ডসেটের নাগালের মধ্যে।

এই ওয়াকিটকিগুলির অধিকাংশই চিনে তৈরি। প্রথমে বিভিন্ন ই-কমার্স সংস্থা বা অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে ভারতে এগুলি পাওয়া যাচ্ছিল। তার পরে বৈদ্যুতিন পণ্যের খোলাবাজারেও অবাধে বিক্রি শুরু হয়। অম্বরীশ বলছেন, ‘‘গোটা দেশেই অনেকে ওই ওয়াকিটকি কিনতে শুরু করেন। তার মধ্যে নানা বেসরকারি নিরাপত্তা পরিষেবা সংস্থা, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা রয়েছে। তারা আমাদের ফ্রিকোয়েন্সিতে ঢুকে পড়লে আমাদের কাজ ব্যাহত হয়। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনও এই সব ওয়াকিটকি হ্যান্ডসেট কিনে অবাধে নিজেদের মধ্যে সাঙ্কেতিক ভাষায় বার্তার আদানপ্রদান করতে পারে।’’

বেআইনি হ্যান্ডসেটের রমরমা বাড়লে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হতে পারে বলে তাঁদের সংগঠনের তরফে প্রধানমন্ত্রীর দফতরকেও চিঠি লেখা হয়েছিল বলে অম্বরীশের দাবি। পরে হ্যাম রেডিয়োর ফ্রিকোয়েন্সিতে ‘রহস্যজনক’ কথাবার্তা ধরা পড়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককেও তা জানানো হয়। জানানো হয় উপভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রককেও। কিন্তু পহেলগাঁওয়ে হামলা তদন্তকে ত্বরান্বিত করেছে। অম্বরীশের বক্তব্য, ‘‘বেআইনি হ্যান্ডসেট ব্যবহার করে যে বিপজ্জনক কাজ হচ্ছিল, সে কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের লোকজনও মেনেছেন। আমার দেওয়া তথ্য তাঁদের কাজে লেগেছে বলে মন্ত্রকের আধিকারিকেরা পহেলগাঁও হামলার পর আমাকে জানিয়েছেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement