রানওয়েতে শুয়ে ত্রাসের প্রহর গুনল কয়েকশো লোক

যেন যুদ্ধক্ষেত্র! ফাঁকা মাঠে উপুড় হয়ে শুয়ে সার দেওয়া মানুষ। হাতে রাইফেলটাই যা নেই! থরথরিয়ে কেঁপে উঠছে পেটের নীচের কংক্রিট! জায়গাটার পোশাকি নাম ‘টারম্যাক।’ যেখানে বিমান এসে দাঁড়ায়। এখানেই রানওয়ে। একটু দূরে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল, যার ভিতরটা তখন খাঁ খাঁ করছে।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩৭
Share:

নেপাল থেকে ফেরার পর কলকাতা বিমানবন্দরে এক পর্যটক। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

যেন যুদ্ধক্ষেত্র! ফাঁকা মাঠে উপুড় হয়ে শুয়ে সার দেওয়া মানুষ। হাতে রাইফেলটাই যা নেই! থরথরিয়ে কেঁপে উঠছে পেটের নীচের কংক্রিট! জায়গাটার পোশাকি নাম ‘টারম্যাক।’ যেখানে বিমান এসে দাঁড়ায়। এখানেই রানওয়ে। একটু দূরে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল, যার ভিতরটা তখন খাঁ খাঁ করছে। কারণ, যাঁরা বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন, সেই এটিসি-অফিসারেরা থেকে শুরু করে বিমানবন্দরের সাধারণ কর্মী বা বিভিন্ন বিমানসংস্থার লোকজন— আমযাত্রীদের মতো তাঁরাও টারম্যাকের কংক্রিটে উপুড় হয়ে শুয়ে! সকলের মুখে-চোখে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। কাঁপুনির চোটে যদি পেটের নীচের কংক্রিটে চিড় ধরে! তা হলেই তো সবশুদ্ধ অতল সমাধি!

Advertisement

ঘটনাটা শনিবারের হলেও তার চব্বিশ ঘণ্টা বাদে, রবিবার দুপুরে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমে প্রশান্ত গঙ্গোপাধ্যায় এমন ভাবে বর্ণনা করছিলেন, যেন এই মাত্র সেই আতঙ্কের গহ্বর থেকে উঠে এলেন! বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে বারবার জল ছিটিয়ে যেন উৎকণ্ঠার দাগ ধুয়ে ফেলতে চাইছিলেন।

কম্পন-ধ্বস্ত কাঠমান্ডু থেকে প্রশান্তবাবুর মতো আরও ৭৩ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে এয়ার ইন্ডিয়া-র বিমান একটু আগে কলকাতায় নেমেছে। যাত্রীদের কেউ পঁচাত্তরের বৃদ্ধ, ভ্রমণসংস্থার হাত ধরে নেপাল বেড়াতে গিয়েছিলেন। কেউ নবীন যুবা, ট্রেকিংয়ের অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে পাড়ি দিয়েছিলেন নেপালের পাহাড়ে। কাউকে যেতে হয়েছিল স্রেফ কাজের খাতিরে। প্রকৃতির রুদ্ররোষের মুখে পড়ে সকলেই বিপর্যস্ত। সামান্য দু’-একটা প্রশ্নের জবাবে হুড়মুড়িয়ে উগড়ে দিচ্ছিলেন ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার বিবরণ।

Advertisement

যেমন দিলেন প্রশান্তবাবু। বেসরকারি সংস্থার পদস্থ কর্তাটি আদতে মুম্বইয়ের বাসিন্দা। এ দিন তাঁর কলকাতায় আসার কোনও কথা ছিল না। অফিসের কাজে নেপালের রাজধানী শহরে গিয়েছিলেন। ঠিক ছিল, শনিবার দুপুরে কাঠমান্ডু থেকে ইন্ডিগো-র উড়ানে দিল্লি ফিরবেন। সময় মতো ত্রিভুবন বিমানবন্দরে পৌঁছেও যান। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যাগ সবে এক্স-রে মেশিন থেকে বেরিয়েছে। পুরো টার্মিনাল দুলে উঠল। সিকিওরিটিরা চেঁচিয়ে বলল, টারম্যাকে পালিয়ে যান। কয়েকশো লোক দৌড়ে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।’’ এর পরেই ত্রিভুবন বিমানবন্দর স্তব্ধ হয়ে যায়। সারা বিশ্বে বার্তা ছড়িয়ে যায়, কাঠমান্ডু থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত কোনও বিমান উড়বে না।

অগত্যা প্রশান্তবাবু ট্যাক্সি ধরে বিরাটনগর ফেরার চেষ্টা করেন, যদি সেখান থেকে দিল্লির উড়ান পাওয়া যায়। পথে নানা মর্মন্তুদ দৃশ্য দেখেছেন। বাড়ির লোকের খবর না-পাওয়া ট্যাক্সিচালকের আকুল কান্না বুকে শেলের মতো বিঁধেছে। বারবার ভূমি কাঁপানো রাত কাটিয়েছেন হোটেলের বাইরে।

উপায় না-দেখে এ দিন সকালে আবার কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে পৌঁছে গিয়েছিলেন প্রশান্ত। দেখেন, এয়ার ইন্ডিয়া’র একটা বিমান কলকাতায় যাচ্ছে। ‘‘আমি তখন মরিয়া। যে ভাবে হোক, ফিরতে হবে।’’— বললেন প্রশান্ত।

কাজটা অবশ্য সহজ হয়নি। প্রশান্ত প্রথমে ক্রেডিট কার্ডে বিমানের টিকিট কাটার চেষ্টা করেন। বিমানবন্দরে ‘লিঙ্ক’ না-থাকায় পারেননি। শেষমেশ স্থানীয় এক পরিচিতের কাছে কুড়ি হাজার টাকা ধার করে টিকিট কেটে বিমানে ওঠেন। এ দিন কলকাতায় নেমে মুম্বইয়ের টিকিট কাটার সময়ে জানালেন, ‘‘সকালেও ত্রিভুবনের মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তবে কালকের মতো নয়।’’

কলকাতার এক ভ্রমণসংস্থার সঙ্গে নেপালে বেড়াতে যাওয়া একটি দলও এ দিন কলকাতায় ফিরেছে। ভ্রমণার্থীদের অধিকাংশ বয়স্ক। যেমন, জয়ন্তপ্রকাশ রায়। পঁচাত্তরের বৃদ্ধ জানালেন, ১৮ তারিখ তাঁরা কাঠমান্ডু পৌঁছন। শনিবার দুপুরে ফেরার উড়ান ছিল। বিমানবন্দর যাবেন বলে স্ত্রী কৃষ্ণাকে নিয়ে হোটেলের রিসেপশনে দাঁড়িয়ে চেক-আউট করছিলেন। তখনই নেমে এল বিপর্যয়। ‘‘প্রথমে সামান্য একটু দুলুনি। রিসেপশনের মেয়ে দু’টি চিৎকার করে উঠল, দুলছে, দুলছে। কিছু বুঝে ওঠার আগে অদৃশ্য কোনও শক্তি যেন এক ধাক্কায় আমাদের মাটিতে ছিটকে ফেলে দিল!’’— বলতে বলতে ফের বিহ্বল হয়ে পড়েন জয়ন্তবাবু।

তখন কী করলেন?

বৃদ্ধ জানালেন, চারপাশের তুমুল হট্টগোলের মধ্যে ওঁরা খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রবল দুলুনির চোটে মেঝে থেকে উঠতেও পারছিলেন না। রিসেপশনের একটি মেয়ের সাহায্যে দু’জনে কোনও ক্রমে দাঁড়াতে পেরেছেন। তার পরে শনিবার সারা দিন-সারা রাত বৃদ্ধ দম্পতির সময় কেটেছে রাস্তায়। খোলা আকাশের নীচে, হাজারো জনতার সঙ্গে ত্রাসের আঁচ পোহাতে পোহাতে।

দুঃসহ স্মৃতিতে মগ্ন অনীক সোমও। এন্টালির যুবকটি ট্রেকিংয়ে গিয়েছিলেন নেপালে। এবং সেই পোখরাতেই, যা কিনা ভূকম্পের খাস উৎসস্থল! যদিও শনিবারের ভূমিকম্পের সময়ে ওঁরা পোখরা ঘুরে কাঠমান্ডু নেমে এসেছিলেন। অনীক জানালেন, কাঠমান্ডুতে তাঁরা উঠেছিলেন বসন্তপুরে। ওই তল্লাটে সব পুরনো হোটেল। সবই এখন ধ্বংসস্তূপ। ‘‘আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে আসার মুখে মাটি কাঁপতে শুরু করল। বরাত জোরে প্রাণে বেঁচে গিয়েছি।’’

এখনও ঘোরের মধ্যে রয়েছেন অনীক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন