আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে আর্থিক সমীক্ষা

‘আচ্ছে দিন’ মনে হচ্ছে ‘আনেওয়ালে হ্যায়’। দিল্লির মসনদ দখলের লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদীর ফেরি করা সেই স্বপ্নই যেন এ বার উঠে এসেছে প্রাক্ বাজেট আর্থিক সমীক্ষায়। পরিসংখ্যানের বুনোটে। কিন্তু প্রশ্নচিহ্ন সহ। শুক্রবার প্রকাশিত এই সমীক্ষায় পূর্বাভাস, আগামী আর্থিক বছরেই (২০১৫-’১৬) ৮% ছাপিয়ে যাবে বৃদ্ধির হার।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৫২
Share:

Advertisement

‘আচ্ছে দিন’ মনে হচ্ছে ‘আনেওয়ালে হ্যায়’। দিল্লির মসনদ দখলের লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদীর ফেরি করা সেই স্বপ্নই যেন এ বার উঠে এসেছে প্রাক্ বাজেট আর্থিক সমীক্ষায়। পরিসংখ্যানের বুনোটে। কিন্তু প্রশ্নচিহ্ন সহ।

শুক্রবার প্রকাশিত এই সমীক্ষায় পূর্বাভাস, আগামী আর্থিক বছরেই (২০১৫-’১৬) ৮% ছাপিয়ে যাবে বৃদ্ধির হার। পৌঁছবে ৮.১ থেকে ৮.৫ শতাংশে। এমনকী কয়েক বছরের মধ্যে তা টপকে যাবে ১০ শতাংশের গণ্ডিও। সে ক্ষেত্রে বিশ্বে সব থেকে দ্রুত বৃদ্ধির দেশ হিসেবে চিনকে অনেক পিছনে ফেলে দেবে ভারত। শুধু তা-ই নয়, মূল্যবৃদ্ধি সে ভাবে মাথাচাড়া দেবে না। বাণিজ্যে শ্রীবৃদ্ধি হবে। নিয়ন্ত্রণে থাকবে রাজকোষ ঘাটতিও। ফলে এই সমস্ত সুখবরে বলীয়ান অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্ম্যণনের দাবি, এ বার পরিকাঠামোয় বেশি টাকা ঢালতে আর ধার বাড়াতে হবে না। অর্থনীতির রথ ছুটবে টগবগিয়ে।

Advertisement

এই পর্যন্ত শুনলে মনে হয় যেন, শনিবার স্রেফ ফুল বিছানো রাস্তায় হেঁটে বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। কিন্তু বাস্তব যে তেমন নয়, তা স্পষ্ট সুব্রহ্ম্যণনের কথাতেই। তিনি বলছেন, বৃদ্ধির এই বিদ্যুৎ গতির দৌড়ে তিনি নিজেই কিছুটা হতবাক। শিল্পমহলেরও প্রশ্ন, কয়েক মাস আগেও ৬% বৃদ্ধির দাগ ছুঁতে খাবি খাচ্ছিল যে অর্থনীতি, এখন এমন অক্লেশে তা ১০ শতাংশের দিকে পা বাড়াচ্ছে কী ভাবে? তবে কি জিডিপি (দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) মাপার পদ্ধতিতে যে বদল কেন্দ্র এনেছে, অর্থনীতিকে হঠাৎ ঝকঝকে দেখানোর চাবি সেখানেই লুকিয়ে?

সুব্রহ্ম্যণনই জানিয়েছেন, অর্থনীতি বুলেট গতিতে এগোচ্ছে, এমনটা ভাবতে তিনি নারাজ। তবে বিশ্বজোড়া মন্দার প্রকোপ এবং সব থেকে খারাপ সময় কাটিয়ে যে তা দ্রুত বেরিয়ে আসছে, সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ নেই।

আসলে পরিসংখ্যানেরও অদ্ভুত বৈপরীত্য রয়েছে এ বারের সমীক্ষায়। বৃদ্ধির হার চড়া। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন এবং রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে। ফুলেফেঁপে উঠছে বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ার। এক কথায়, অর্থনীতির ডানা মেলার সব লক্ষণই প্রায় স্পষ্ট। অথচ গত তিন মাসে দেশের ১০০টি বড় সংস্থার আয় কমেছে ৬%। শেয়ার বাজারে থলি উপুড় করে দিচ্ছে বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলি। কিন্তু কল-কারখানা গড়তে বিদেশি বিনিয়োগ এখনও তেমন আসছে না। রফতানি বাজার স্তিমিত। চাহিদা পুরোপুরি মাথা তোলেনি দেশের বাজারেও।

এই পরিস্থিতিতে সুব্রহ্ম্যণন মনে করছেন, আক্ষরিক অর্থেই অর্থনীতির এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাজেট পেশ করতে চলেছেন জেটলি। লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি তাঁর পিছনে। পেয়েছেন ভাগ্যের সহায়তা। কারণ, বিশ্ব বাজারে অশোধিত তেলের দাম হু হু করে নেমে আসায় রাজকোষ ঘাটতিতে লাগাম পরাতে সুবিধা হয়েছে তাঁর। পেট্রোল-ডিজেলে বাড়তি কর বসিয়ে জোগাড় করতে পেরেছেন পরিকাঠামোয় ঢালার অর্থ। কিন্তু এই সমস্ত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে দ্রুত বৃদ্ধির কক্ষপথে নিয়ে গিয়ে ফেলতে এখন প্রয়োজন সাহসী সংস্কার।

সাধারণত আর্থিক সমীক্ষা যে রকম ‘দুর্বোধ্য’ ভাষায় লেখা হয়, অনেকে বলছেন, এ বারেরটি সে দিক থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম। সম্ভবত আর একটি দিক থেকেও কিছুটা ব্যতিক্রমী সুব্রহ্ম্যণন। অর্থনীতির যুক্তির সঙ্গে তিনি মনে রেখেছেন রাজনীতির বাধ্যবাধকতা। যে কারণে সংস্কার চেয়েছেন। কিন্তু তা নিয়ে ধমাকা (বিগ ব্যাং) চাননি। তাঁর মতে, সংস্কারের পথে ছোট ছোট পা বাড়াতে হবে। তা করতে হবে নিয়মিত, নাছোড় ভাবে। তা হলেই সেগুলি জুড়ে জুড়ে রূপ নেবে বড় মাপের সংস্কার।

উপদেষ্টা মনে করেন, ডিজেলের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া, গ্যাসের দাম বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি ছাঁটাই, গরিব মানুষের হাতে সরাসরি নগদে ভর্তুকি, কয়লা খনির নিলাম, দ্রুত পণ্য-পরিষেবা কর চালু করা, জন-ধন যোজনায় সাফল্য, জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধন ইত্যাদি পদক্ষেপ জুড়ে জুড়েই ছুটতে পারে বড় মাপের সংস্কারের রথ।

অনেক দিন থেকেই সুব্রহ্মণ্যন বলছেন, বৃদ্ধির চাকায় গতি ফেরাতে পরিকাঠামোয় বিপুল লগ্নি প্রয়োজন। মোদী-জমানায় দেশের শিল্পমহলের মধ্যে নতুন করে উদ্দীপনা তৈরি হলেও, এখনও লগ্নি করতে দু’বার ভাবছে তারা। দরজা খুলে দেওয়া সত্ত্বেও এখনও সে ভাবে আসেনি বিদেশি লগ্নি। এই পরিস্থিতিতে চাকা ঘোরানোর প্রাথমিক দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে বলে সওয়াল করেছেন তিনি। এ দিনের সমীক্ষা যদি ইঙ্গিত হয়, তা হলে বাজেটে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের কথা বলতে পারেন জেটলি। এবং তিনি তা করবেন রাজকোষ ঘাটতিকে লাগাম পড়িয়েই।


সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

সুব্রহ্ম্যণন মনে করছেন, বাজপেয়ী জমানায় পরিকাঠামো গড়তে সড়ক যে ভূমিকা নিয়েছিল, মোদী-রাজে তা হতে পারে রেল। রেল বাজেটে সুরেশ প্রভু ঘোষণাও করেছেন যে, পাঁচ বছরে রেলের পরিকাঠামোয় সাড়ে ৮ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হবে। যে ভাবে অর্থনীতির ভিত শক্ত করতে চিন রেল-পরিকাঠামোয় জোর দিয়েছে।

রেলমন্ত্রী প্রভু এ বার তাঁর বাজেটে নতুন ট্রেন বা স্টেশনের তালিকা দেননি। জোর দিয়েছেন থমকে থাকা প্রকল্প শেষের উপর। সেই একই ছবি আর্থিক সমীক্ষাতেও। অর্থ মন্ত্রকের হিসেবে, ৮ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি প্রকল্প আটকে রয়েছে। যা জিডিপি-র প্রায় ৭%। শুধু ওই প্রকল্পগুলি শেষ করতে পারলেই অর্থনীতিতে গতি ফেরানো সম্ভব। সুব্রহ্মণ্যন মনে করেন, আপাত দৃষ্টিতে ছোট ছোট এই সব কাজ যত্ন নিয়ে করে যেতে পারলেই ১০% বৃদ্ধির মাইলফলক পেরোতে পারে অর্থনীতি।

অনেক ‘কিন্তু’ তার পরেও থাকে। যা সরকারের হাতের বাইরে। যেমন, ভাল কৃষি উৎপাদনের জন্য দরকার ভাল বর্ষা। শিল্প উৎসাহিত হবে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদ কমালে। পরিকাঠামোয় লগ্নির সুযোগ কমবে তেলের দর হঠাৎ বেড়ে গেলে। সমস্যা ডেকে আনতে পারে হঠাৎ লাগা যুদ্ধ কিংবা অন্য কোথাও ঘনিয়ে আসা মন্দা।

কিন্তু সেই সব দুর্ভাবনা সরিয়ে রাখলে, অর্থনীতি সত্যিই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বলে মনে করছে সমীক্ষা। জেটলির দায়িত্ব সেই ‘আচ্ছে দিন’কে বরণ করার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন