অ্যাম্বুল্যান্সে দেহের পাহাড়, দরজা ধরে ঝুলছেন আত্মীয়েরা, বাড়ছে ক্ষোভ
Plane Crash In Ahmedabad

আর কত অপেক্ষা, নেই উত্তর

কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনে ছুটতে শুরু করলেন মৃতের পরিজনেরা। কেউ অ্যাম্বুল্যান্সের গায়ে চাপড় মারতে শুরু করলেন, কেউ দরজা ধরে ঝুলে পড়ে টেনে খোলার চেষ্টা শুরু করলেন।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ ০৭:২৮
Share:

বেশিরভাগেরই দেহ জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে দুর্ঘটনা-পরবর্তী বিস্ফোরণে। —ফাইল চিত্র।

এলাকা জুড়ে হঠাৎই বিকট গন্ধ। টেকা যাচ্ছে না। আমদাবাদ বি জে মেডিক্যাল কলেজের ময়না তদন্তের ঘরের সামনে শনিবার ভোরে পরপর এসে দাঁড়াচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্স। কী ব্যাপার? দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলো ছোটাছুটি শুরু করলেন। দেখা গেল, ময়না তদন্তের ঘরের গেট বরাবর একে একে দাঁড়াচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্স আর তাতে তড়িঘড়ি টেনে তোলা হচ্ছে মৃতদেহ। একটি অ্যাম্বুল্যান্স মরদেহ তুলে ছুটতে শুরু করলেই তার জায়গা নিচ্ছে আর একটি!

কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনে ছুটতে শুরু করলেন মৃতের পরিজনেরা। কেউ অ্যাম্বুল্যান্সের গায়ে চাপড় মারতে শুরু করলেন, কেউ দরজা ধরে ঝুলে পড়ে টেনে খোলার চেষ্টা শুরু করলেন। তড়িঘড়ি পুলিশ ঘোষণা শুরু করল, “ময়না তদন্তের ঘর ভরে গিয়েছে, তাই মৃতদেহ স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। চিন্তার কিছু নেই। সময় মতো পরিবারের হাতে মৃতদেহ তুলে দেওয়া হবে।”

আর কখন? আর কত সময় পেরোলে পাওয়া যাবে প্রিয়জনের দেহ? চিৎকার শুরু করেন অনেকেই। বিমান দুর্ঘটনার পরে তিন দিন পেরোলেও দেহ কবে হাতে পাওয়া যাবে, তা বিমান দুর্ঘটনায় মৃতদের আত্মীয়দের অধিকাংশেরই জানা নেই। ক্ষোভে ফুটছেন তাঁরা। অনেকেরই অভিযোগ, ভিন্ রাজ্য থেকে তড়িঘড়ি বিমান ধরে এসে বৃহস্পতিবার রাতেই ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। এরপর ৬০ ঘণ্টারও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কিছুই জানতে পারছেন না। প্রশ্ন করলে বলে দেওয়া হচ্ছে, কিছু জানার হলে সরকারের দেওয়া টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করুন। নয়তো বলা হচ্ছে, সময়মতো জানিয়ে দেওয়া হবে। অনেকেরই অভিযোগ, টোল ফ্রি নম্বরে ফোন করলেও অনেক সময়েই কেউ ফোন ধরছেন না। কখনও কখনও ফোনে বলা হচ্ছে, “যে ভাবে মৃতদেহ এসেছে, দিয়ে দিলেও নিতে পারবেন না। তাই যখন ডাকা হবে, তখনই আসবেন।”

এই অসহায় পরিস্থিতিতে ক্ষোভ আরও বেড়েছে শুক্রবার ময়না তদন্তের ঘরের কিছু ছবি সামনে চলে আসায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ঘরের গেট পেরিয়ে ঢুকতেই বাঁ দিকে মাটিতে পড়ে সার সার দলা পাকানো মৃতদেহ। ডান দিকের ঘরে আবার একটির উপর একটি মৃতদেহ ডাঁই করে রাখা। ভিতরে ঢুকে পাশাপাশি দুটো ঘরেরও একই অবস্থা। সেই ময়না তদন্তের ঘরেই দুপুরে কোনও মতে ঢোকা গিয়েছিল। মাটিতে পরপর শোয়ানো দেহের কোনওটিকেই চেনার উপায় নেই। গলে পড়েছে গায়ের মাংস। হাত-পা, মাথার ঘিলু পরস্পরের সঙ্গে দলা পাকিয়ে রয়েছে। ঝলসানো কোনও দেহে শুধু দাঁতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে। গন্ধ এমন যে, কয়েক মুহূর্তের বেশি টেকা যায় না। ময়না তদন্তের ঘরে এমন উপচে পড়া মৃতদেহ সামলাতে না পেরেই শুক্রবার দুপুর থেকে বিকল্প ভাবতে শুরু করে গুজরাত সরকার। এর সঙ্গেই পরিজনের ক্ষোভ আঁচ করে তারা। অনেকেই বলতে শুরু করেন, “ঝলসে যাওয়া দেহ কি পচিয়ে ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে? শেষকৃত্য হবে কী করে?” এই পরিস্থিতিতেই এ দিন ভোররাত থেকে ময়না তদন্তের ঘরে থাকা মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া শুরু করে প্রশাসন। কিছু দেহ নিয়ে যাওয়া হয় সিভিল হাসপাতালের সদ্য নির্মিত মর্গে। কিছু নিয়ে যাওয়া হয় পুরনো (স্থানীয় ভাষায় জুনা) ট্রমা সেন্টার ভবনের ঠান্ডা ঘরে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৭০ জনের। বি জে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জুনিয়র ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ধবল গামিতি জানান, বিমানের ২৪১ জন যাত্রী ছাড়াও মেডিক্যাল হস্টেলের চার জন চিকিৎসক পড়ুয়া মারা গিয়েছেন। হস্টেল থেকে আনা হয়েছে আরও ২১টি মৃতদেহ। হস্টেলের আশপাশ থেকে যে ক’জনকে আনা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে চার জনের মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু কত দেহ হাসপাতালে রয়েছে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছুই জানানো হয়নি। জানা যাচ্ছে না, কবে দেহগুলি পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হবে? স্পষ্ট করা হচ্ছে না সব মিলিয়ে কত দেহের ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট এসেছে বা কত দেহের ডিএনএ নমুনা পরিবারের নমুনার সঙ্গে মিলেছে। যদিও অসমর্থিত সূত্রের খবর, শনিবার রাত পর্যন্ত ৩৯টি মৃতদেহের ডিএনএ-র নমুনা মিলে গিয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, এ দেশে প্রায় নজিরবিহীন এই বিমান বিপর্যয়ের পরেও আরও তৎপরতা কেন দেখা যাবে না? মৃতের পরিজনের প্রশ্ন, যেখানে গোটা পরিস্থিতিকে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, সেখানে কেন আরও লোক বাড়িয়ে সামাল দেওয়া হবে না? বি জে মেডিক্যাল কলেজের ডিন মীনাক্ষী পারেখ বলেন, “আমদাবাদের সমস্ত সরকারি হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি, বায়ো কেমিস্ট্রি, ফরেন্সিক মেডিসিনের চিকিৎসকেরা এক জায়গায় একসঙ্গে কাজ করে চলেছেন। বি জে মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে রাত-দিন কাজ হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এফএসএল টিম এসেছে। কিন্তু মৃতদেহ থেকে ডিএনএ নিয়ে পরিবারের কারও ডিএনএ-র সঙ্গে মিলিয়ে দেখার, পরীক্ষা করার যে নিয়ম, তা মেনে ৭২ ঘণ্টা সময় দিতেই হবে। তবে এখন পরিস্থিতি বুঝে আরও কয়েক ঘণ্টা কম সময়ের মধ্যে করে ফেলা যায় কি না, দেখা হচ্ছে।”

মৃতের আত্মীয়দের ক্ষোভের মধ্যেই এ দিন হাসপাতালে ঢোকে একাধিক সাদা কফিন। তারই ছ’টিতে ছ’জনের দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় বলে জানাচ্ছে হাসপাতাল। সঙ্গে সঙ্গেই রটে যায়, মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। বাকিরাও পেয়ে যাবেন।

কিন্তু কখন? অপেক্ষা আর শেষ হচ্ছে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন