বীথিকা দেব এবং দিলীপ পাল
১৯৮৩ সাল থেকে দেখলে শিলচরকে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের ঘাঁটি বলা মুশকিল। কংগ্রেস এখানে চার বার জিতেছে। বিজেপিও চার বার।
শেষ বার ৩৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে উপনির্বাচনে জেতেন বিজেপির দিলীপকুমার পাল। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই যে কঠিন, এ কথা স্বীকার করছেন কংগ্রেসের সব স্তরের নেতারাই। আর তা জেনেবুঝেই ময়দানে পা রেখেছেন বীথিকা দেব। তাঁর কাছে বড় ভরসা পরিচিতি। নিজে শিলচর পুরসভার সভাপতি ছিলেন। ছিলেন বিধায়কও। এর চেয়ে বড় কথা, তিনি প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষমোহন দেবের স্ত্রী। বর্তমান সাংসদ সুস্মিতা দেবের মা।
বর্তমান ভোটের বাজারে মেয়েই প্রধান শক্তি কংগ্রেস প্রার্থীর। নিজে পুরপ্রধান বা বিধায়ক থাকার সময় কংগ্রেসের অন্তর্কলহে এলাকার জন্য বিশেষ কোনও কাজ করতে পারেননি। ফলে ২০১১ সালের তাঁর মেয়াদ ফুরোনোর আগে বলেই ফেলেছিলেন— ভগবান এলেও এই আসনে কংগ্রেসের জেতা সম্ভব নয়। সে বার মায়ের জায়গায় প্রার্থী হন মেয়ে সুস্মিতা। জিতেও যান। বিধায়ক থেকে মেয়ে এখন সাংসদ। ফলে নিজের সময় বাদ দিয়ে বীথিকাদেবী মেয়ের কাজকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। সঙ্গে সন্তোষমোহন দেবের নাম উল্লেখ করে জনতার আবেগ টানার চেষ্টা করছেন।
বিজেপি প্রার্থী দিলীপকুমার পালের প্রচারেও আসছে বাবা-মেয়ের কথা। সংবাদমাধ্যমের কাছে দিলীপবাবু বীথিকা দেবকে দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী বললেও, সন্তোষ-জায়া বিপক্ষে দাঁড়ানোয় তিনি যে কিছুটা চাপে রয়েছেন, তা তাঁর ঘনিষ্ঠজনরাও মেনে নেন। এর পরও তাঁদের দাবি— ‘শেষ পর্যন্ত জিতবেন দিলীপদাই।’
তবে মেয়ের উপর পুরসভা, বিধানসভার আসন ছেড়ে বীথিকা দেব অনেকদিন থেকে রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। এটাই চাপের মধ্যেও স্বস্তি দেয় দিলীপবাবুকে। সেখানেও অবশ্য কংগ্রেস প্রার্থী বীথিকাদেবী সন্তোষমোহন দেবকে টেনে আনছেন। তাঁর কৈফিয়ত, ‘‘আপনাদের রানাদার (সন্তোষমোহন) জন্যই তো আমাকে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে কয়েক দিন সরে থাকতে হল। তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দিল্লি নিয়ে যেতে হল। তাঁকে বিছানায় রেখে তো আর আমি বেরিয়ে আসতে পারি না!’’ জেলা কংগ্রেসের সভাপতি কর্ণেন্দু ভট্টাচার্য শোনান, ‘‘বৌদির জয় নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। আমরা মাঠে ছিলাম, আছি। তাঁর হয়ে আমরাই কাজ করেছি।’’
শুধু উপনির্বাচন নয়, লোকসভা ভোটের ফল দেখলেও কর্ণেন্দুবাবুর দাবি ধোপে টেঁকে না। সে বার শিলচর বিধানসভা আসনে কংগ্রেস পায় ৫৭ হাজার ৪৫টি ভোট। বিজেপির ঝুলিতে যায় ৭৫ হাজার ৪১৬ ভোট। ৫ হাজার ৩৩০টি ভোট পায় এআইইউডিএফ। কয়েক মাস পর শিলচর বিধানসভার উপনির্বাচনে কংগ্রেসের (প্রার্থী ছিলেন অরুণ দত্ত মজুমদার) ভোট কমে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৪৫৭। বিজেপি মোটামুটি একই জায়গায় থেকে যায়। দিলীপকুমার পাল ৭৪ হাজার ৮৯৮টি ভোট পেয়ে বিধায়ক হন। সে বার এআইইউডিএফ-এর নুর আহমদ বড়ভুঁইঞা ১১ হাজার ২০৩টি ভোট টেনেছিলেন।
এ বার শিলচরে এআইইউডিএফ প্রার্থী দেয়নি। মোট ১৫ প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে দিলীপকুমার পাল, বীথিকা দেব ছাড়াও রয়েছেন সুপ্রিয় ভট্টাচার্য (সিপিএম), প্রদীপকুমার দেব (এসইউসিআই), শাহিন আহমেদ চৌধুরী (সমাজবাদী পার্টি)। দীর্ঘদিনের ভোটের ফলাফল এবং বিভিন্ন দলের সাংগঠনিক অবস্থা বিশ্লেষণে এ কথা আগাম বলা যায়, শিলচরে কার্যত কংগ্রেস ও বিজেপির সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে লোকসভা বা উপনির্বাচনে এআইইউডিএফ যে ভোট পেয়েছিল, এর পুরোটা বীথিকাদেবী পাবেন ধরে নিলেও দিলীপবাবুর বিশাল ভোটের মোকাবিলা খুব কঠিন। এই বিষয়টি বুঝেই প্রার্থী ঘোষণার পর মাটি কামড়ে শিলচরে পড়ে রয়েছেন সাংসদ-কন্যা সুস্মিতা। তাঁর দাবি, ‘‘গেরুয়া ভোটে বিরাট ধস নেমেছে। ১৬-১৭ মাসে দিলীপবাবুকে দেখে নিয়েছেন শিলচরের ভোটাররা। এখন মোহভঙ্গ ঘটেছে। বিধায়ক এলাকা উন্নয়ন তহবিল ছাড়া কোনও প্রকল্পে একটি টাকাও আনতে পারেননি তিনি। কোনও রাস্তায় কাজ হয়নি। ব্যর্থতার দায় এড়াতে ভোটের মুখে অনশনের নাটক করেছেন।’’
বিজেপির ভোটে ধস নামার
কথা দিলীপবাবু হেসে উড়িয়ে দেন। তবে প্রচারে দিনরাত সময় দেওয়া থেকে স্পষ্ট, ময়দান যে উপনির্বাচনের মতো উর্বর নয়, তা তিনিও টের পাচ্ছেন। আজ সকালে তারাপুরের অলিতে-গলিতে হেঁটে বিকেলে সভার পর সভা করে চলেছেন। রাত পর্যন্ত বিরাম নেই। বীথিকা দেব যেমন কথায়-কথায় সন্তোষমোহন দেবকে টেনে আনছেন, দিলীপবাবু তেমনি
দেব পরিবারের হাত থেকে শিলচর রক্ষা করার ডাক দিচ্ছেন। বীথিকা দেবের দাবি, অন্য জেলা থেকে শিলচরের যে পরিকাঠামোগত সুবিধে বেশি, এর কৃতিত্ব সন্তোষমোহন দেবের। পাল্টা দিলীপবাবু বলেন, ‘‘অন্য জায়গার তুলনায় লামডিং-শিলচর ব্রডগেজে অতিরিক্ত সময় লাগল কেন, এর কারণও সন্তোষমোহন দেব।’’ বলেছিলেন বরাক ড্যামের কথা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরির কথা। কোথায় সেসব, জানতে চান দিলীপকুমার পাল।
সুস্মিতাদেবীর সোজা কথা, ভোটের বাক্সে সবকিছুর জবাব দেবেন শিলচরের মানুষ।