আজব বাজারে। জুনবিলের মাঠে মায়ের কোলে শিশু। — নিজস্ব চিত্র।
কথায় বলে সে রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। জুনবিলের মাঠে আক্ষরিক অর্থেই প্রচলিত প্রবাদের প্রতিফলন মিলল।
কোথায় গোভার মহারাজা সাধুকুমার, কোথায় বা মাজুলি থেকে মরিগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর টিওয়া সাম্রাজ্য!
আজ টিওয়াদের দরবার বসাতে গেলেও অন্যের জমি ধার নিতে হচ্ছে। কিন্তু টিমটিম করেও জুনবিলে টিঁকে রয়েছে বিনিময় প্রথার এক ব্যতিক্রমী ঐতিহ্য। তার লেনদেনের বাজার। তিন দিন জুনবিলের মানুষের টাকা থাকবে পকেটেই। আলুর বদলে মিলবে চাল, আদা-হলুদের বদলে পায়রা, চালকুমড়োর বিনিময়ে মাছ!
সেই টিওয়া রাজত্বের আমল থেকেই সমতল আর পাহাড়, অসম আর মেঘালয়ের মানুষের মেলবন্ধনের প্রতীক হিসেবে বসত জুনবিলের বাজার। সেখানে মুদ্রার চল ছিল না। বেচাকেনা চলত বিনিময়ের মাধ্যমেই। পঞ্চদশ শতকে শুরু হওয়া সেই নৈমিত্তিক বাজারই এখন বার্ষিক নিয়মরক্ষার পরবে পরিণত হয়েছে। মেলা বসে মাঘ বিহুর পরের প্রথম বৃহস্পতিবার। চলে তিন দিন।
মরিগাঁও জেলার জাগি রোড থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে জুনবিলে এই সময় চলে সমবেত মাছ ধরা। বিল থেকে ওঠে আঁড়, বোয়াল, চিতল, শোল, ল্যাটা। পাশের জমিতে বসে জুনবিলের মেলা। সেখানে কার্বি ও মেঘালয়ের বিভিন্ন উপজাতির সহস্রাধিক মানুষ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে বিনিময়ের জন্য হাজির হন। মেঘালয় থেকে আসা মানুষরা সঙ্গে আনেন আদা, হলুদ, কচু, কুমড়ো, আলু, স্থানীয় পিঠে। আজকাল অবশ্য মেলায় থাকে খাট, মোড়া, বিভিন্ন হস্তশিল্পের পসরা। সে সব কিনতে অবশ্য টাকাই ভরসা।
জুনবিলের মেলার বড় আকর্ষণ মোরগের লড়াই। আশপাশের এলাকা থেকে তাগড়া মোরগের পায়ে ছুরি বেঁধে হাজির হন লড়িয়ের দল। চলে বাজি ধরা। লড়াই দেখতে অনেক দূর থেকেও মানুষ ভিড় জমান জুনবিলে।
মেলার মধ্যমণি অবশ্য গোভার মহারাজা আর তাঁর দরবারে হাজির ১৮ জন ছোট রাজা। কপালের ফেরে সকলেই এখন সরকার থেকে মেলা সামান্য ভাতার উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু এই কয়েক দিন রাজার প্রতাপ দেখে কে! বরবরুয়া, সেনাপতি, ডেকা দলৈ, বরদলৈ, আরান্ধারা ও খাতানিয়ার-সহ রাজপরিষদের সকলকে নিয়ে হাজির দেওরাজা দীপ সিংহ। মেলার প্রথম দিনে দেওশাল মন্দিরে পুজো করার পরে সকলে মিলে একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারেন। তার মধ্যেই ফিসফিসিয়ে চলে কম ভাতার জেরে ভাতে টান পড়ার আক্ষেপ।
আগামী কাল সকালে বসবে প্রধান দরবার। সেখানে ১৮ জন টিওয়া রাজাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেও রাজা। থাকবেন স্বশাসিত পরিষদের মুখ্য কার্যবাহী আধিকারিক রমাকান্ত দেউড়ি। রাজা খোদ হাজির থাকলেও প্রধান অতিথি হতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। তিনি আসছেন বলেই জাগিরোড থেকে মরিগাঁও জেলার ভাঙাচোরা পথ দ্রুত সারিয়ে তোলা হচ্ছে। দেউড়ি এ দিন বলেন, ‘‘রাজ দরবার যে জমিতে বসছে- সেটা ধার করা জমি। এত বড় ঐতিহাসিক মেলার জন্যও জমি অন্যের কাছ থেকে লিজ নিতে হয়। ১৫ বছর ধরেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এ নিয়ে আর্জি জানানো চলছে। সামনেই নির্বাচন। এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী এখানে আসছেন। সেই সুযোগে পাকাপাকি জমির ব্যবস্থা-সহ টিওয়াদের জন্য বেশ কয়েকটি দাবি আদায়ে তাঁর কাছে দরবার করব। কপাল ভাল হলে তিনি এ নিয়ে কিছু ঘোষণাও করতে পারেন।’’
গগৈয়ের আসার আগে মেলার মাঠের পাশে তৈরি অস্থায়ী হেলিপ্যাডে নামে হেলিকপ্টারও। রাজার দরবার ফাঁকা করে মুখ্যমন্ত্রী আকাশ-রথ দেখতে ছুটে যাওয়া ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন গোভারাজা। গণতন্ত্র বড় বালাই। রাজার চেয়ে আজ মুখ্যমন্ত্রীর দাম বেশি। রাজা হাত পেতে রয়েছেন মন্ত্রীর দয়ার দানের জন্য!