ব্যবধানটা আড়াই বছরের। ২০১২-এর ডিসেম্বরের এক রাতে দিল্লিতে ধর্ষণের পরে চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল বছর কুড়ির তরুণীকে। এ বার ঘটনাস্থল পঞ্জাব। শ্লীলতাহানিতে বাধা দেওয়ায় চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেওয়া হল বছর চোদ্দোর কিশোরীকে। রেহাই পেলেন না মা-ও। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে কিশোরীর। হাসপাতালে আশঙ্কাজনক মা। ঘটনায় এখনও পর্যন্ত বাস কন্ডাক্টর-সহ দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পঞ্জাব পুলিশ।
বুধবার সন্ধেয় ঘটনাটি ঘটেছে মোগা শহরের কাছে। ভাগাপুরানার গুরুদ্বারে যাওয়ার জন্য দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাসটিতে উঠেছিলেন বছর চল্লিশের এক মহিলা। মোগা-কোটকাপুরা রাস্তার উপর হঠাৎই চড়াও হয় বারো জনের একটি দল। মহিলা এবং তাঁর কিশোরী মেয়ের উদ্দেশে কটূক্তি করতে থাকে তারা। এমনকী কিশোরীটিকে যৌন হেনস্থার চেষ্টাও করে বলে অভিযোগ। মহিলা বাধা দিতে গেলে মারধর করা হয় তাঁকে। বাসে তখন গুটিকয়েক যাত্রী ছিলেন। তবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি কেউই। উপায় না দেখে চালককে বাস থামাতে অনুরোধ করেন মহিলা। অভিযোগ, তা না শুনে উল্টে আরও জোরে বাস চালাতে থাকে চালক। কিশোরী চিৎকার করতে থাকলে কাঁচের জানলা ভেঙে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয় তাকে। এর পর দরজা খুলে ছুড়ে ফেলা হয় মাকেও। রাস্তায় উপস্থিত লোকজন মোটরবাইক, সাইকেলে বাসটিকে তাড়া করলে মাঝপথেই বাস থামিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। রাস্তায় তখন পড়ে রয়েছে কিশোরীর রক্তাক্ত দেহ। কিছু দূরে যন্ত্রণায় ছটপট করছেন মা।
দু’জনকে উদ্ধার করে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয়েরা। সেখানে কিশোরীকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালের আইসিসিইউ বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয় তার মাকে। ঘটনার আকস্মিকতা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিশোরীর বছর দশেকের ভাইটি।
পরে তাকে পরিবারের সদস্যদের তুলে দেয় পুলিশ।
কন্ডাক্টর সুখবিন্দর সিংহকে জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, বাসটি ‘অরবিট এভিয়েশন’ নামের একটি সংস্থার হাতে রয়েছে। আর সেই সংস্থার অন্যতম মালিক পঞ্জাবের উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিংহ বাদল। সুখবীর পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদলের ছেলে।
ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের নাম জড়ানোয় রাজ্যের অকালি-বিজেপি জোট সরকারের বিরুদ্ধে লোকসভায় সরব হয় কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টি (আপ)। সুখবীরের স্ত্রী হরসিমরত কৌর বাদল আবার কেন্দ্রের মন্ত্রী। বিরোধীদের তোপের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। বিষয়টি নিয়ে বাদল সরকারের কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়েছে কেন্দ্র।
মোগার ঘটনাকে নির্ভয়া-কাণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে কংগ্রেসের বিধায়ক রবনীত সিংহ বিট্টু বলেন, ‘‘বাসটির মালিক মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারেরই এক জন। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের তরফে স্বচ্ছ তদন্তের আশা রাখি না।’’ আর তাই বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তিনি। আপের আবার অভিযোগ, শুধু একটি ঘটনা নয়। এর আগেও একাধিক বার নানা অপরাধে নাম জড়িয়েছে ‘অরবিট এভিয়েশন’-এর। রাজনৈতিক যোগ থাকার কারণে কোনও নিয়মের ধার ধারে না তারা। মাদক পাচারের অভিযোগও রয়েছে ওই সংস্থার বিরুদ্ধে।
গোলমালের জেরে পরিস্থিতি সামাল দিতে মিনিট পাঁচেকের জন্য অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজান। বিষয়টি নিয়ে সরব হন বসপা প্রধান মায়াবতী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উমা ভারতীও। ঘটনায় সহযাত্রীদেরও সমান ভাবে দায়ী করেছেন তাঁরা। কিশোরী-মৃত্যুর এই ঘটনা নির্ভয়ার কথা করিয়ে দিয়েছে দিল্লির মহিলা কমিশনের প্রধান বরখা শুক্লাকেও। দোষীদের কঠিনতম শাস্তির জন্য ফাস্ট
ট্র্যাক আদালতে মামলার শুনানি চেয়েছেন তিনি।
কিশোরীর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে মোগায় গিয়েছিলেন পঞ্জাব কংগ্রেসের সভাপতি প্রতাপ সিংহ বাজওয়া। তখনও মহিলার জ্ঞান না ফেরায় কথা হয়নি তাঁদের। পরে তিনি বলেছেন, ‘‘সুবিচার এবং মানবিকতার খাতিরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত পঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের।’’ পঞ্জাবের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় দিনের শেষে মুখ খোলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিংহ বাদল। ঘটনাটিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে দ্রুত তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। ‘অরবিট এভিয়েশন’-কে নিয়ে বিতর্কের প্রশ্নে বলেছেন, সংস্থাটি পরিবারের অধীনে হলেও তার সঙ্গে কোনও যোগ নেই তাঁর। সংস্থার অফিসে এক দিনের জন্যও যাননি তিনি। রাজ্যের ডিজিপি সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, ধৃতদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের চেষ্টা, খুন আর খুনের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বাসটি। তদন্তের স্বার্থে সে সময় বাসে থাকা অন্য যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। কিশোরীর মায়ের জ্ঞান ফিরলে রেকর্ড করা হবে তাঁর বয়ান।
নির্ভয়া-কাণ্ডের পর গণপরিবহণে মহিলাদের সুরক্ষা নিয়ে একাধিক পদক্ষেপ করেছিল কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলি। তাতে আখেরে যে লাভ হয়নি, বুধবারের ঘটনা আরও এক বার চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল।