সড়ক আছেই। সেগুলোকে মহাসড়কে, ‘এশিয়ান হাইওয়ে’ বা এশীয় মহাসড়কে উন্নীত করতে হবে। তবেই প্রসন্ন হবেন বাণিজ্যলক্ষ্মী।
অঙ্কটা পাটিগণিতের। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে বাণিজ্য বাড়বে। আর ব্যবসা বাড়লে সরকারের ঘরে বেশি রাজস্ব আসবে। এই সহজ নিয়ম মেনেই সার্ক-ভুক্ত নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে ‘এশিয়ান হাইওয়ে’ তৈরির কাজ শুরু করেছে সরকার।
রাজ্যের পূর্ত দফতরের জাতীয় সড়ক বিভাগের এক কর্তা জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তরবঙ্গে তিন জেলায় রাস্তার দু’ধারে বিদ্যুতের খুঁটি বসানো, জলের লাইন পাতা, গাছ কাটার কাজ শুরু হয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক চললে ২০১৭ সালের মধ্যে হাইওয়ে তৈরি শেষ হয়ে যাবে।
মূলত দু’টি রাস্তার কাজ হবে এশিয়ান হাইওয়ে প্রকল্পে। তার মধ্যে একটি যাবে কাঁকরভিটা, পানিট্যাঙ্কি, বাগডোগরা, শিবমন্দির ও নৌকাঘাট থেকে ফুলবাড়ি হয়ে বাংলাদেশ। অন্যটিরও গন্তব্য বাংলাদেশ। তবে ফুন্টশোলিং, জয়গাঁ, হাসিমারা, ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি ও চ্যাংড়াবান্ধা হয়ে। প্রথমটির নাম ‘এশিয়ান হাইওয়ে-২’। দ্বিতীয়টি ‘এশিয়ান হাইওয়ে-৪৮’। ওই পূর্তকর্তা জানান, রাস্তাগুলির অস্তিত্ব রয়েছে। নতুন প্রকল্পে সেগুলি চওড়া ও মজবুত করা হবে। সংস্কারের এই কাজ হবে মূলত উত্তরবঙ্গের তিন জেলা জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার আর কোচবিহারে।
পূর্ত দফতরের খবর, এশীয় মহাসড়ক-২ প্রায় সাড়ে ৩৭ কিলোমিটার লম্বা। এখন ওই রাস্তা এতই সঙ্কীর্ণ যে, বড়জোর পাশাপাশি দু’টি গাড়ি যেতে পারে। বেশ কিছু জায়গায় রাস্তা আরও সরু। সংস্কার করে ওই রাস্তার ১০ কিলোমিটার অংশে চারটি লেন চালু করা হবে। বাকি অংশটি হবে দু’লেনের। তৈরি হবে চারটি উড়ালপুল। শুধু ওই রাস্তার উন্নয়নে খরচ ধরা হয়েছে ৬০০ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা। এশীয় মহাসড়ক-৪৮-এর দৈর্ঘ্য ৯০.৫৭ কিলোমিটার। ওই রাস্তার উপরে জয়গাঁ ও হাসিমারায় দু’টি করে ‘বাইপাস’ এবং হাতি চলাচলের জন্য তিনটি ‘আন্ডারপাস’ তৈরি হবে। ওই রাস্তা সংস্কারের খরচ ধরা হয়েছে ৯৭১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। জাতীয় সড়ক বিভাগের কর্তা জানান, ভারত-সহ চারটি দেশের সীমান্ত এলাকা এই প্রকল্পে যুক্ত। তাই এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক বা এডিবি এতে আর্থিক সহযোগিতা করছে।
দু’টি রাস্তা সংস্কার ও সম্প্রসারণের জন্য জমি লাগবে সামান্যই। পূর্ত দফতর সূত্রের খবর, দু’নম্বর এশিয়ান হাইওয়ের জন্য জমি লাগবে ৯.৬ হেক্টর। শিলিগুড়ির কাছে শিবমন্দিরে দু’টি বাইপাস গড়ার জন্য এই জমি দরকার। ৪৮ নম্বর এশিয়ান হাইওয়ের জন্যও খুব অল্প জমির প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। কোচবিহারের তৃণমূল জেলা সভাপতি তথা বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ঘোষের আশ্বাস, ‘‘রাস্তার জন্য জমি পেতে অসুবিধা হবে না।’’ রাস্তা দু’টির কাজ দ্রুত শেষ করতে শিলিগুড়ি ও ময়নাগুড়িতে দু’টি অফিস খুলেছে পূর্ত দফতর।
কিন্তু এই ধরনের মহাসড়ক প্রকল্পে এডিবি আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন?
নবান্নের কর্তারা জানান, বাংলাদেশের কু়ড়িগ্রাম জেলার উল্টো দিকে চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্তে চেকপোস্ট রয়েছে। ওই সীমান্ত-ফাঁড়ি পেরিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ পণ্যবাহী লরি যাতায়াত করে। পাথর, গম, ফল-সহ বিভিন্ন পণ্য যায় বাংলাদেশে। আবার বাংলাদেশ থেকে আসে জামাকাপড়, তুলো, ইট। রাস্তা উন্নত হলে আমদানি-রফতানির পরিমাণ বাড়বে। তাতে রাজস্ব আদায় বেশি হবে কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারেরই। ওই কর্তারা জানান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘গেটওয়ে’ বা সদর-ফটক শিলিগুড়ি। এশিয়ান হাইওয়ের কাজ শেষ হলে শিলিগুড়ির গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে।
কী বলছেন আমদানি-রফতানি ব্যবসায় যুক্ত লোকজন?
চ্যাংড়াবান্ধা চেকপোস্ট দিয়ে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়। আমদানি হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সামগ্রী। পরিসংখ্যান দিলেন ফেডারেশন অব এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনের পশ্চিমবঙ্গ শাখার যুগ্ম সম্পাদক সমীর ঘোষ। বললেন, ‘‘সন্দেহ নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে ব্যবসার আয়তনও বেড়ে যাবে।’’ তিনি জানান, চ্যাংড়াবান্ধা ছাড়াও বালুরঘাটের হিলি, মালদহের মহদিপুর, বনগাঁর পেট্রাপোল, ঘোজাডাঙা স্থল-সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রফতানি হয়। নদিয়ার গেদে এবং মালদহের সিংহাবাদ দিয়ে রেলে পণ্য চলাচল করে। আবার উত্তর দিনাজপুরের রাধিকাপুর চেকপোস্ট খোলার চেষ্টা করছে কেন্দ্র। ‘‘সব ক্ষেত্রেই পণ্য পরিবহণের জন্য উন্নত রাস্তা খুব জরুরি,’’ বলেন সমীরবাবু।