National News

ভোটের এই গুজরাতে আর যাই থাক, ‘গুজরাত মডেল’ নেই

এই কি সেই গুজরাত, মাত্র তিন বছর আগে যেখানকার উন্নয়নের মায়ালু স্বপ্নে গোটা দেশকে মজিয়ে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী নামে এক আশ্চর্য বাঁশিওয়ালা?

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

অমদাবাদ শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ২১:৪৯
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি:পিটিআই।

সংশয়টা শুরু হয়েছিল গুজরাতে আসার আগে হোমওয়ার্কের পর্যায় থেকেই। নির্বাচনী চালচিত্র বোঝার জন্য সাংবাদিকতার প্রাথমিক এবং আবশ্যিক কর্তব্য সেটা। অমদাবাদে আসা ইস্তক সেই ধন্দ আরও গাঢ় হল। এই কি সেই গুজরাত, মাত্র তিন বছর আগে যেখানকার উন্নয়নের মায়ালু স্বপ্নে গোটা দেশকে মজিয়ে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী নামে এক আশ্চর্য বাঁশিওয়ালা? হিন্দুত্বের যাবতীয় তাস অনেক পিছনে ফেলে রেখে নরেন্দ্র মোদী আসমুদ্রহিমাচল ভারতকে দেখিয়েছিলেন তাঁর সেই যাদুদণ্ড, আপামর দেশবাসী যাকে এত দিন গুজরাত মডেল বলেই জানত। স্বপ্নে ভেসেছিল ভারত, সংখ্যায় ভেসেছিল বিজেপি।
সংশয়টা সেই কারণেই তীব্র হল। এই কি সেই গুজরাত, যার স্বপ্ন ফেরি হয়ে থাকে দেশ জুড়ে? দ্বিতীয় তথা শেষ​ দফার ভোটগ্রহণের ক্ষণটাতে দাঁড়িয়ে গুজরাতের আনাচে-কানাচে উন্নয়নের সেই স্বপ্নগুলোকে দেখা যাচ্ছে না কেন? শোনা যাচ্ছে না কেন গুজরাত মডেলের কথা? এখনও তেমন ঠান্ডা পড়েনি অমদাবাদে। সন্ধে নামে ধূসর হয়ে, ধোঁয়া ও ক্লান্তির ঘোলাটে আচ্ছাদনে নিজেকে মুড়ে নেয় অমদাবাদ। এই অমদাবাদে বা এই গুজরাতে পাটিদার বিক্ষোভ রয়েছে, দলিত আন্দোলন রয়েছে, অনগ্রসর শ্রেণির উষ্মা রয়েছে। সে সব ঢেকে দেওয়ার জন্য গুজরাতি অস্মিতার প্রচার রয়েছে, রয়েছে হিন্দুত্বের সেই পুরনো গর্জন। এসেছে ‘পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের’ কথাও। এই অমদাবাদে বা গুজরাতে সবই রয়েছে, শুধু উন্নয়নের স্বপ্নটা নেই।
কথাটা সহজ করে বোঝার চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক, আপনার রান্নাঘরে নানান পদ নিয়ে আপনি সাতকাহন করে থাকেন সব সময়। সেই রান্নাঘরে এই পদ হয়, সেই পদ হয়, বলে আপনি দাবি করে থাকেন। নিজের রান্নার নানান গুণ, তার রূপ-রস-গন্ধ-স্বাদের অনন্যতা ইত্যাদির প্রচারে গোটা এলাকা আপনি মাতিয়ে রাখেন। পাড়া-পড়শি মেনেও নিয়েছেন আপনার শ্রেষ্ঠত্ব। এক দিন সময় এল, যখন আপনাকে সবার সামনে খুলে দিতে হচ্ছে রান্নাঘরের দরজাটা, অসংখ্য মানুষ সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন আপনার শ্রেষ্ঠত্বের কূটকৌশল এবং আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করছেন, আপনার রান্নাঘরটা নিতান্ত আটপৌরে, আর পাঁচটা বাড়ির মতোই। তাঁরা এও দেখছেন যে, রান্নাঘরটা আটপৌরে বলেই আপনি ক্রমাগত দৃষ্টিটাকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন জানালা দিয়ে একেবারে বাইরের দিকে, যার সঙ্গে আর যাই হোক, রান্নার কোনও সম্পর্ক নেই। ওই রান্নাঘর, ওই রান্না, তার যাদু, তার মশলা— সব কিছুই আসলে ছিল স্বপ্ন, ছিল মিথ।

Advertisement

আরও পড়ুন:

রোজ ফোন আর ডেরা বদল, হার্দিক যেন মাওবাদী নেতা

Advertisement

‘আমাদের জন্য নয়, ভোটের কারণেই ওরা তালাক-বিরোধী’


হুবহু মিলে যাচ্ছে গুজরাতের দৃশ্যের সঙ্গে। আশ্চর্য সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত মডেল এবং নরেন্দ্র মোদীর অগ্নিপরীক্ষার ক্ষেত্র গুজরাত। মোদী শুধু গুজরাতের ভূমিপুত্রই নন, মোদী গুজরাত-স্বপ্নের সওদাগরও। সেই স্বপ্নে ভেজালের মিশেল রয়েছে, এই সংশয়ও যদি জাগে, ভারতকুলতিলক নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে তা অত্যন্ত লজ্জার। সেটা জানেন বলেই, দিল্লির রাজধর্ম পাশে সরিয়ে রেখে, গত দিনগুলোয় গুজরাতেই শিবির গেড়েছিলেন নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী।

দেখুন ভিডিও:


যে গুজরাত মডেলের ‘সাফল্যের’ হাওয়ায় গত ১৫টা বছর বিজেপি তার আধিপত্যকে আরও নিরঙ্কুশ করে এসেছে, সেই মডেলই এ বার সঙ্কটে ফেলছে তাদের। প্রদীপের আলোর নীচেই অন্ধকার, প্রাবচনিক এই আপ্তবাক্য এখন উঠে আসছে গুজরাতের হৃদয় থেকে। উন্নয়নের প্রাথমিক চমক লাগানো লক্ষণগুলোকে পিছনে সরিয়ে এ বার উঠে আসছে কর্মসংস্থানহীন উন্নয়নের অভিযোগ (পাটিদারদের বিক্ষোভের মূল উৎস সেইখানেই)। উঠে আসছে বড় শিল্পকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য দেওয়া বিপুল ভর্তুকি কী ভাবে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে সরকারি বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে বছরের পর বছর। এক কথায়, সব রক্তকে মুখে আনতে গিয়ে গোটা শরীরকে যে ধীরে ধীরে রক্তশূন্য করে তোলা হয়েছে, এতগুলো বছর পর প্রকট হয়ে আসছে এই সত্য। বেশ কয়েক বছর আগে চন্দ্রবাবু নায়ডুকেও এই সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়েছিল। ঠিক এই প্রশ্নেই হারতে হয়েছিল প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের কাছে। গুজরাতের মসনদে কে আসবে, সে পরের কথা। কিন্তু তার আগে লড়াই থেকে ক্রমাগত ছিটকে যেতে থাকা কংগ্রেস যে আসরটাকে জমিয়ে তুলতে পারল, নরেন্দ্র মোদীকে যে ক্রমাগত আক্রমণ শানাতে হল রাহুল গাঁধী ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে, যে কারণে চলে এল বাবর-ঔরঙ্গজেব-পাকিস্তান-নীচ ইত্যাদি প্রসঙ্গও, এতে একটা লজ্জার বিষয় রয়েছে। সে কথা বিজেপি কর্মীরাও একান্তে স্বীকার করছেন।
গুজরাতে আসলে দেশের জন্য একটা অশনি সঙ্কেত রয়েছে। ব্যর্থতার ন্যূনতম যে ভাবে বার করে নিয়ে এল উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নখ-দাঁতগুলোকে, তাতে ভয় হয়, অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ থেকে সম্পূর্ণ সরে শুধুই মেরুকরণের পথে না হাঁটতে শুরু করে শাসক দল। সে অবশ্য পরের কথা। তার আগে এই মুহূর্তে প্রস্তুতি শেষ গুজরাতের ময়দানে। অগ্নিপরীক্ষার মুখে দু’জনই। গুজরাতের ভূমিপুত্র নরেন্দ্র মোদী কি এ বারও বহাল রাখতে পারবেন তাঁর অশ্বের দুর্নিবার গতি? নাকি অশ্বমেধের ঘোড়াকে এই গুজরাতের মাটিতেই আটকে দিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করবেন রাহুল গাঁধী? গোটা দেশ উত্তরের অপেক্ষায়।

গুজরাত নির্বাচন নিয়ে সব খবর পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন