অনাহারে থেকেই এমন হুমকি ব্রু উদ্বাস্তুদের। —ফাইল চিত্র।
রেশন বন্ধ কুড়ি দিন ধরে। ত্রিপুরায় অনাহারে দিন কাটছে ব্রু উদ্বাস্তুদের। উপায় না দেখে সরকারি শস্যভাণ্ডার লুঠের হুমকি দিলেন তাঁরা। হাজারো নিয়ম-কানুনের জেরে রেশন পৌঁছতে দেরি হয়েছে বলে সাফাই দিচ্ছেন সরকারি আধিকারিকরা। তবে এ ভাবে চললে খুব শীঘ্র উদ্বাস্তু শিবিরে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে বলে রাজ্য প্রশাসনকে সতর্ক করে দিয়েছে ভূমিহারা মানুষদের সংগঠন দ্য মিজোরাম ব্রু ডিসপ্লেসড পিপলস ফোরাম (এমবিডিপিএফ)।
উদ্বাস্তু শিবিরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ত্রিপুরার জেলাশাসক সি কে জামাতিয়ত কে যৌথ ভাবে চিঠি দিয়েছেন এমবিডিপিএফ-এর সাধারণ সম্পাদক ব্রুনো মাহা এবং সভাপতি এ সাওয়িবুঙ্গা। তাঁরা জানিয়েছেন, প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে উদ্বাস্তু শিবিরে রেশন পৌঁছনোর কথা। কিন্তু এপ্রিল মাসের ২০দিন কেটে গেলেও এখনও পর্যন্ত রেশন এসে পৌঁছয়নি।
চিঠিতে ব্রুনো মাহা এবং এ সাওয়িবুঙ্গা আরও জানান, রেশনে গতমাসে যে চাল দেওয়া হয়েছিল, তা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। খাবারের অভাবে অনাহারে দিন কাটছে মানুষের। তাঁদের শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। রেশন পাঠাতে আর দেরি করলে উদ্বাস্তু শিবিরে অনাহারে মৃত্যু হতে পারে অনেকেরই।
আরও পড়ুন: ‘চার্চে হতে পারে আত্মঘাতী হামলা’, আগেই সতর্ক করেছিলেন শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধান!
উদ্বাস্তু শিবিরে রেশন পৌঁছে দিতে রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে পদক্ষেপ করতে হবে বলে দাবি করেছেন তাঁরা। তা না হলে পথ অবরোধ এবং নিকটবর্তী সরকারি গুদামে হানা দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না বলে হুমকিও দিয়েছেন।
তবে কাঞ্চনপুরের সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট অভেদানন্দ বৈদ্য জানান, ‘‘গত ৩১ মার্চ রেশন সরবরাহ স্থগিত রাখতে নির্দেশ দিয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। যার পর নতুন নির্দেশে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রেশন সরবরাহের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সেই নতুন নির্দেশ মেনে নিয়ম-কানুন সারতে অনেকটা সময় লেগে গিয়েছে। তাই সময়মতো রেশন পৌঁছে দেওয়া যায়নি। তবে আগামী এক দু’দিনের মধ্যে উদ্বাস্তু শিবিরে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেব আমরা।’’
তবে প্রায় প্রতিমাসেই রেশন পৌঁছতে দেরি হয় বলে দাবি এমবিডিপিএফ নেতৃত্বের। তাঁদের কথায়, গত চার বছর ধরে এমনটাই চলে আসছে। প্রতিমাসে নির্ধারিত সময়ের ১০-১২দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর রেশন এসে পৌঁছয়।
আরও পড়ুন: ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই ফের বিস্ফোরণ শ্রীলঙ্কায়, আট বিস্ফোরণের বলি অন্তত ১৮৫, দেশজুড়ে কার্ফু
১৯৯৭ সালে জাতি সঙ্ঘর্ষের সময় মিজোরামের মামিত, কোলাসিব এবং লুঙ্গলেই জেলা থেকে ব্রু উপজাতির বহু মানুষ পড়শি রাজ্য ত্রিপুরায় পালিয়ে আসেন। বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন উত্তর ত্রিপুরার কাঞ্চনপুর, পানিসাগর মহককুমার ছয়টি উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেন তাঁরা। এই মুহূর্তে সেখানে প্রায় ৩৫ হাজার উদ্বাস্তু রয়েছেন।
২০১০ সালে ত্রিপুরা থেকে ব্রু উপজাতিদের মিজোরামে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হলে কিছু মানুষ ফিরে যান। কিন্তু দাবি-দাওয়া পূরণ না হলে ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই বলে থেকে যান অনেকেই। যার পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে, পাঁচ হাজার ৪১৩ পরিবারের আরও ৩২ হাজার ৮৫৭ উদ্বাস্তুকে শনাক্ত করে মিজোরাম সরকার। খুব শীঘ্র তাঁদের রাজ্যে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। বরং ২০ বছর ধরে ত্রিপুরার বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরেই দিন কাটছে মিজোরাম থেকে পালিয়ে আসা ব্রু উপজাতিদের।
ত্রিপুরার উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে এই মুহূর্তে প্রায় ৩৫ হাজার উদ্বাস্তু রয়েছেন। সংখ্যাটা নিয়ে মতভেদ রয়েছে যদিও, তবে তাঁদের দূরবস্থা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন পাঁচ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। চাল দেওয়া হয় ৬০০ গ্রাম করে। দিনে আড়াই টাকা করে ভাতা দেওয়া হয় অপ্রাপ্তবয়স্কদের। তাদের চাল দেওয়া হয় ২৫০ গ্রাম করে। বছরে তিনটির বেশি সাবান পাওয়া যায় না। বছরে একটা হাওয়াই চপ্পল এবং প্রতি তিন বছরে একটা মশারি মেলে সেখানে।
আরও পড়ুন: চোরাশিকারী ধরতে গিয়ে আক্রান্ত ডিএফও-সহ ৮ বনকর্মী
উদ্বাস্তু শিবিরগুলির এমন পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৪-য় ত্রিপুরা হাইকোর্ট পর্যন্ত সরব হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। এখনও পর্যন্ত সেখানে চিকিত্সা পরিষেবা এবং পানীয় জলের জোগান পৌঁছয়নি বলে জানিয়েছেন এমবিডিপিএফ নেতৃত্ব। নেই সরকারি কোনও প্রকল্পে কাজের সুযোগও। তাঁদের অভিযোগ, চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে ত্রিপুরা সরকার। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে উদ্বাস্তুদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলছে ত্রিপুরা সরকার, যাতে রাজ্য থেকে বেরিয়ে যান তাঁরা।
কিন্তু মিজো সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামগুলিতে ফিরে যেতে এখনও নিরাপদ বোধ করছেন না ব্রু-রা। ব্রু অধ্যুষিত আলাদা গ্রামের দাবি তুলেছেন তাঁরা, যাতে সায় নেই মিজোরাম সরকারের। পরিবার পিছু পাঁচ হেক্টর জমি, একটি করে সরকারি চাকরি এবং দেড় লক্ষ টাকার দাবিও এখনও পর্যন্ত মেনে নেয়নি মিজোরাম সরকার। ব্রু উদ্বাস্তু সংগঠনের স্বশাসিত জেলার দাবিতেও আপত্তি রয়েছে তাদের। বরং এই ধরনের অন্যায্য দাবি তুলে ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করা হচ্ছে বলে উদ্বাস্তু সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলেছে তারা।
(কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাত থেকে মণিপুর - দেশের সব রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)