উৎক্ষেপণের সেই মুহূর্ত। কাছেই কন্ট্রোল রুম থেকে সেটাই দেখছেন নরেন্দ্র মোদী। পাশে (বাঁ দিকে) ইসরোর প্রাক্তন বিজ্ঞানী বি এন সুরেশ। সোমবার শ্রীহরিকোটায়। ছবি: এএফপি
সস্তা ও সার্ক।
ভারতের মহাকাশ-চর্চার সঙ্গে আজ এই দু’টি শব্দকে খুবই অর্থবহ ভাবে জুড়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রকেট পাঠানোই হোক বা কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করা মহাকাশ বিজ্ঞানে ভারত যে বিশ্বের অন্যতম নির্ভরযোগ্য দেশ, ইসরো আজ আরও এক বার তা প্রমাণ করে দিল উন্নত দেশগুলির পাঁচটি কৃত্রিম উপগ্রহ সফল ভাবে মহাকাশে পাঠিয়ে। আর সেই সাফল্যকে উপলক্ষ করেই মোদী আজ জানিয়ে দিলেন, ‘ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর’। হৃদয় চাইছে আরও। দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে তাঁর অনুরোধ, এ বার এমন একটা উপগ্রহ বানান, যা সার্ক দেশগুলির কাজে আসে। সেটাই হবে প্রতিবেশী দেশগুলিকে ভারতের উপহার।
সাফল্যের উচ্ছ্বাস বা আবেগের কথা নয়। কেন তাঁর হৃদয় এটা চাইছে, তার ব্যাখ্যায় মোদী বুঝিয়ে দিয়েছেন, নির্ভরযোগ্যতা অর্জনের ধাপ পেরিয়ে মহাকাশ-বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় ভারতেকে আরও সফল দেখতে চান তিনি। এবং সেই সাফল্য যে আসবেই, সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই তাঁর। কারণ, ভারতে মহাকাশ-চর্চা ঢের সস্তা। যে বিপুল অর্থ ব্যয় করে মার্কিন গবেষণা কেন্দ্র নাসা মঙ্গলগ্রহে যান পাঠায়, ভারতের তা করতে ছ’ভাগের এক ভাগও খরচ হয়নি। নাসার লেগেছিল ৪৫.৫ কোটি ডলার। আর ভারতের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইসরো মঙ্গলযান পাঠিয়েছে মাত্র ৭.৩ কোটি ডলারে। এই তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি মোদী টেনে আনেন হলিউডির ছবির প্রসঙ্গও। গত বছর ১০ কোটি ডলার খরচ করে তৈরি হয়েছিল জর্জ ক্লুনি ও সান্দ্রা বুলক অভিনীত ব্রিটিশ-মার্কিন থ্রি-ডি থ্রিলার ‘গ্র্যাভিটি’। মোদী বলেন, “শুনেছি, আমাদের মঙ্গল অভিযানের চেয়েও নাকি হলিউডি ছবি ‘গ্র্যাভিটি’ তৈরিতে বেশি খরচ হয়েছিল। এটা একটা বিশাল সাফল্য।” সন্দেহ নেই, এই তুলনা বিশ্বের প্রতি একটা বার্তা। উন্নত দেশগুলি যাতে আরও বেশি ভাবে ভারতকেই গন্তব্য করে তোলে উপগ্রহ পাঠানোর ক্ষেত্রে। বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার বাজারে পশ্চিমী দুনিয়া ভারত থেকে কাজ করিয়ে নেওয়া তথা আউটসোর্সিং কমানোর নীতি নিয়েছিল। কিন্তু মহাকাশ-চর্চার খরচ কমাতে হলে পশ্চিমকে যে ভারতের সস্তা ও নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তির উপরে আরও বেশি ভরসা করতে হবে, সেটা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন আদতে গুজরাতের বাসিন্দা প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু নির্ভেজাল ব্যবসায়িক প্রসঙ্গের মধ্যেই কেন সার্ক দেশগুলিকে জন্য উপগ্রহ উপহার কথা বলছেন মোদী? বলছেন, কারণ বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভের পাশাপাশি কূটনীতিতে সার্কের মন জয়ও আর একটি বিশেষ লক্ষ্য তাঁর। দেশের মহাকাশ-চর্চাকে এই জোড়া লক্ষ্য পূরণের সঙ্গে জুড়ে দিতে চাইছেন তিনি।
সার্ক সম্পর্কে বার্তাটা ছিল তাঁর শপথের অনুষ্ঠানেই। সেটাই এ বার আরও জোরালো ভাবে দিলেন মোদী। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতকে আরও শক্তিশালী জায়গায় তুলে ধরতে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির জোট সার্ক-এর মঞ্চকে ভিত করতে চান তিনি। নিজের শপথের অনুষ্ঠানে তাই বেনজির ভাবে পাশে টেনে এনেছিলেন সার্ক রাষ্ট্রপ্রধানদের। প্রথম বিদেশ সফরের জন্যও বেছে নিয়েছিলেন প্রতিবেশী সার্ক-ভুক্ত দেশ ভুটানকে। এ বার মোদী বুঝিয়ে দিলেন সার্ক দেশগুলির কল্যাণে ভারতকে অগ্রণী ভূমিকায় দেখতে চান তিনি। উন্নত ধনী দেশগুলির সাধ্য থাকলেও প্রতিবেশী সার্ক দেশগুলি কেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সুফল থেকে বঞ্চিত থাকবে? বিশেষ করে ভারতের মতো প্রতিবেশী থাকতে! মোদীর এই বার্তার মধ্যে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির একটি মজবুত ব্লক গড়ে তোলা ও তার নেতৃত্বের জায়গায় নয়াদিল্লিকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসই দেখতে পাচ্ছেন কূটনীতিকরা। অর্থনীতিতে দেশকে মজবুত জায়গায় নিয়ে গিয়েই বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেওয়া তাঁর সরকারের লক্ষ্য। এই ক্ষেত্রে প্রতিবেশী চিনের সঙ্গে টক্কর দেওয়াও মোদীর এই উপগ্রহ-কূটনীতির আর এক লক্ষ্য বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।
এর ফলেই অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় সতীশ ধবন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র আজ হয়ে ওঠে ভারতীয় কূটনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখান থেকেই আজ ভারতের পিএসএলভি সি-২৩ রকেটে চেপে নিজের নিজের কক্ষপথে পাড়ি দেয় ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের মোট পাঁচটি কৃত্রিম উপগ্রহ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদী এই প্রথম বার দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কর্মযজ্ঞের সাক্ষী হলেন। সফল উৎক্ষেপণের পর অভিনন্দন জানানোর ফাঁকে মোদী ইসরো-কর্তাদের বলেন, “এ বার এমন একটি কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করতে হবে যা সার্ক দেশগুলির উন্নয়নের অংশীদার হবে। এই উপগ্রহ ভারত তার প্রতিবেশীদের উপহার দেবে।” দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে ইতিমধ্যেই একাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে ইসরো। তার মধ্যে কয়েকটি আফগানিস্তান ও আফ্রিকার একাধিক দেশকেও তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় সাহায্য করে। এ বার সার্ক দেশগুলিকে সাহায্য করার কথা বলার পাশাপাশি ভারতের প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষা-স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের উন্নতির জন্যও মহাকাশ প্রযুক্তিকে আরও বেশি করে কাজে লাগানোর কথা বলেন মোদী।
মহাকাশ বিজ্ঞানে ভারতের উন্নতির কথা বলতে গিয়ে প্রত্যাশিত ভাবেই মোদী আজ টেনে আনেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং তাঁর জমানার চন্দ্রযান প্রকল্পের পরিকল্পনার কথা। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। বস্তুত, ২০০৮ সালের ওই অভিযানের সাফল্যই মঙ্গল অভিযানকে ত্বরান্বিত করেছে। গত নভেম্বরে মঙ্গলযানের সফল উৎক্ষেপণ এবং তার পরে পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে তা লাল গ্রহের দিকে পাড়ি দেওয়ার পরেই মহাকাশ বিজ্ঞানে বিশ্বের প্রথম তিনটি দেশের মধ্যে চলে এসেছে ভারত। এই প্রসঙ্গে মোদী আজ বলেন, “মধ্যমেধাকে পিছনে ফেলে আমরা উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে এসেছি।”
এক কথা শোনালেন ইসরোর এক মুখপাত্রও। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরেই ভারত বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করছে। তবে মঙ্গল অভিযানের পর ফ্রান্স, জার্মানির মতো উন্নত দেশগুলিও ইসরোর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধছে। এই কাজটা সামলায় মূলত ইসরোর বাণিজ্যিক শাখা ‘অন্তরীক্ষ (ANTRIX)’ নামে মহাকাশ গবেষণা দফতরের অধীন একটি সংস্থা। বিগত বছরগুলিতে মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা আয় হয়েছে এদের মাধ্যমে। ইসরোর মাধ্যমে এ বার কূটনৈতিক সাফল্য অর্জনও লক্ষ্য মোদীর।