অবশেষে সনিয়া-মনমোহনকে চায়ের নিমন্ত্রণ ‘নমনীয়’ মোদীর

এ যেন সত্যিই আঠেরো মাসে বছর! বিরোধী শিবিরের সব থেকে বড় দলের নেত্রী সনিয়া গাঁধীকে চায়ের আমন্ত্রণ জানাতে আঠেরো মাস লেগে গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। এখন এক অন্য অবতারে নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৫ ২০:৫০
Share:

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে চা চক্রে সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহ। ছবি: এএফপি।

এ যেন সত্যিই আঠেরো মাসে বছর!

Advertisement

বিরোধী শিবিরের সব থেকে বড় দলের নেত্রী সনিয়া গাঁধীকে চায়ের আমন্ত্রণ জানাতে আঠেরো মাস লেগে গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর।

এখন এক অন্য অবতারে নরেন্দ্র মোদী। পণ্য ও পরিষেবা কর বিলের বরফ গলাতে তিনি সরাসরি সনিয়া গাঁধী ও মনমোহন সিংহকে ফোন করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আমন্ত্রণ জানালেন। বিলটি নিয়ে কংগ্রেসের যে প্রবল আপত্তি রয়েছে, এমন নয়। কিন্তু বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন না, এই অপবাদ ঘোচানোর দায়েই বরং আরও বেশি করে এই বৈঠক করলেন মোদী। তার আগে সংসদে অম্বেডকর নিয়ে বিতর্কেও বার বার দিয়েছেন বিরোধীদের সঙ্গে ঐকমত্য রচনার বার্তা। নিজেরাও যে ত্রুটিমুক্ত নন, কবুল করেছেন। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে বলেই যে শাসক দল যা খুশি তা করতে পারে, এমন ধারণাও নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তি দেখানোর চেয়ে সহমতের ভিত্তিতে চলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসের মন জয় করতে অম্বেডকরের বিতর্কেও বারবার টেনে এনেছেন নেহরুর স্বীকৃতির কথা। অসহিষ্ণুতা নিয়ে দেশজুড়ে ঝড়ের মধ্যে তিনি যে আসলে সহিষ্ণুতার পথ ধরেই এগোতে চান, সে সাফাইও দিয়েছেন।

Advertisement

আজ প্রথম ধাপ হিসেবে অম্বেডকরের বিতর্কের পর স্পিকারের প্রস্তাবের খসড়া নিয়ে ঐকমত্যে হেঁটেছে সরকার। কংগ্রেস চেয়েছিল ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটি আর তৃণমূলের দাবি ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত করতে। নরেন্দ্র মোদী দুটিই মেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। গত অঠেরো মাসে এমন মোদীকে দেখেনি রাইসিনার অলিন্দ। সংসদের গত অধিবেশনেও যখন জমি বিল সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর বিরোধিতায় ভেস্তে যাচ্ছে, তখনও ফোন তুলে সরাসরি সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে কথা বলার কথা ভাবেননি মোদী। মোদীর ‘ঔদ্ধত্য’ দেখে সনিয়াও আগ্রহী হননি মোদীর সঙ্গে কথা বলতে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মনমোহনের বাড়ি গিয়ে দেখা করেছিলেন মোদী। মনমোহনকে আরসিআর-এও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সনিয়াকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ডাকেননি কখনও। কিন্তু এখন কংগ্রেসই বলছে, ঠেলার নাম বাবাজি। রাহুল গাঁধী তো আজ বলেই ফেললেন, ‘‘এই বৈঠক ডাকা হয়েছে জনতার চাপে। তা না হলে প্রধানমন্ত্রীর কাজের শৈলী এমন নয়।’’

সনিয়া ও মনমোহনকে আমন্ত্রণ জানানোর সময় রাহুলকে ডাকা নিয়েও বিজেপি-র মধ্যে একটি ভাবনা ছিল। কিন্তু আপত্তি ওঠে, পরিবারতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিয়ে লাভ নেই। রাহুলের আজকের মন্তব্য তারই ক্ষোভ হিসেবে দেখছে বিজেপি। ক’দিন আগে পণ্য ও পরিষেবা কর নিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। সনিয়ার সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন প্রণববাবু। কিন্তু সূত্রের খবর, সনিয়া রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেন, পণ্য ও পরিষেবা বিল নিয়ে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু রাহুলের আছে। রাহুলের উপদেষ্টারা এই বিলের তিনটি মৌলিক বিষয় নিয়ে আপত্তি করছেন। রাহুল আজও বলেন, এই তিনটি বিষয় সরকার মেনে নিলে বিলে সমর্থন করতে কোনও আপত্তি নেই। এতে সাধারণ মানুষেরই লাভ হবে।

তবে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ রক্ষা করাটা কতটা সঠিক হবে, তা নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যেও মতপার্থক্য ছিল। অনেকেই বলেছেন, লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যা নিয়ে আসার পর নরেন্দ্র মোদী ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কার দেখিয়ে এসেছেন। এখন বিহার নির্বাচনে ভরাডুবির পর মোদী নমনীয় হয়েছেন। এটিও তাঁর আসল চরিত্র নয়। ফলে ওঁদের ফাঁদে পা দেওয়া উচিত নয়। মনমোহন সিংহের সঙ্গেও আলাদা বৈঠক করেন সনিয়া। পরে অবশ্য মনমোহন বলেন, ‘‘কী বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জানি না। গিয়ে দেখব।’’

কিন্তু বিরোধী শিবিরে যাতে মোদীর অভিপ্রায় নিয়ে কোনও সংশয় না থাকে, তার জন্য সংসদে অম্বেডকর বিতর্কের মঞ্চটিকে প্রধানমন্ত্রী কাজে লাগালেন ঐকমত্য ও সহিষ্ণুতার বার্তা দিতে। তার আগে অবশ্য অরুণ জেটলিকে দিয়ে কংগ্রেসের অভিযোগের জবাব দেওয়ানো হয়েছে। জেটলি আজ সকালে রাজ্যসভায় বিতর্ক শুরু করে ইন্দিরা গাঁধীকে হিটলারের জার্মানির সঙ্গে তুলনা করেছেন। বলেছেন, যাঁরা আজ অসহিষ্ণুতার কথা বলছেন, তাঁরাই জরুরি অবস্থা সমর্থন করে এসেছেন। একইসঙ্গে সঙ্ঘ এবং বিজেপি যে হিন্দুত্বের কথা বলে, সেটিকেও প্রকারান্তরে সমর্থন করেন জেটলি। ধর্মনিরপেক্ষতার জিগির তুলে আসলে বিজেপিকে সাম্প্রদায়িক বলা হচ্ছে, সেটি অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়।

কিন্তু মোদী নিজের বক্তৃতায় এর ধারেকাছে ঘেঁষেননি। বরং বার বার বোঝাতে চেয়েছেন, কত সহনশীল তিনি। সংবিধানের মূল ভাবকে পুঁজি করেই তিনি দেশ চালাচ্ছেন। তাতে ভুল-ভ্রান্তিও হয়। সহমতের ভিত্তিতেই চলতে চান। ঐকমত্য রচনা হলে শেষ অস্ত্র হিসেবে বড় জোর ব্যবহার করা যেতে পারে সংখ্যাধিক্যের শক্তি। কিন্তু মোদী এই মন্তব্য লোকসভার প্রেক্ষিতে বললেও ভালই জানেন, রাজ্যসভার কাঁটা এখনও বিঁধে রয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের পর মোদী ও অমিত শাহ ভেবেছিলেন, একের পর এক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন জিতে রাজ্যসভাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি পৌঁছে যাবেন। কিন্তু এখন সেই স্বপ্নভঙ্গ শুরু হয়েছে। ফলে এখন বিরোধীদের সঙ্গে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব এখনই মজে যেতে চাইছেন না। শেষ পর্যন্ত পণ্য ও পরিষেবা বিল হয়তো পাশ করিয়ে দেবে কংগ্রেস। কিন্তু সংসদে আগামী সপ্তাহেও ‘অধুনা নমনীয়’ মোদীকে আরও বেগ দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। কংগ্রেস আগামী সপ্তাহেই মোদী সরকারের সেই সব মন্ত্রীদের ইস্তফার দাবি জানাবে, যাঁরা সম্প্রতি বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন