পুলিশ হব, দেখেই পালাবে চোর, বলল রোগে আক্রান্ত যুবক

কখনও ভোপাল তো কখনও উদয়পুরের ডাক্তারবাবুদের কাছে ছোটাছুটি। রোম গেল না। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিলেন, এর কোনও ওষুধ নেই। আত্মীয়-পরিজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘ধরে নাও, এ স্বয়ং হনুমানজি-র অবতার।’’

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:০৮
Share:

ললিত পাতিদার, তার দিদির সঙ্গে নিজের বাড়িতে

পাঁচ মেয়ের পরে এক ছেলে। জন্মের পরেই তাকে দেখে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন নার্স। ‘এটা মানুষ না অন্য কিছু!’ ছোট্ট শরীর ঢাকা বড় বড় কালো রোমে!

Advertisement

কখনও ভোপাল তো কখনও উদয়পুরের ডাক্তারবাবুদের কাছে ছোটাছুটি। রোম গেল না। চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিলেন, এর কোনও ওষুধ নেই। আত্মীয়-পরিজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘ধরে নাও, এ স্বয়ং হনুমানজি-র অবতার।’’

মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান সীমানায় মধ্যপ্রদেশের রতলাম শহরের থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে নন্দলোটা গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দা সেই ললিত পাতিদার এখন তেরো বছরের কিশোর। ষষ্ঠ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র। খেলাধুলোতেও বেশ ভাল। বাবা বেঙ্কট রসুন চাষি। টেলিফোনেই জানালেন, ছোটবেলায় ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করার সময় অন্য ছেলেরা ভয় পেলেও ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। এখন স্কুল, পাড়া, আত্মীয়দের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় ললিত। পড়াশোনায় ভাল বলে শিক্ষকেরাও তাকে খুব ভালবাসেন। রোম ছাড়া অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা নেই ললিতের।

Advertisement

জন্মের পর থেকে রোম তার আরও বেড়েছে। শুধু হাত আর পায়ের পাতা ছাড়া সর্বত্র লম্বা-ঘন রোম। চোখ-নাক-মুখ প্রায় ঢাকা! সপ্তাহে-সপ্তাহে বাবা কাঁচি দিয়ে ছেঁটে দেন। আর এই রোমের জন্যই গ্রামে তার বাড়ির আলাদা পরিচিতি। কিন্তু সে নিজে কতটা ‘বিশেষ’ সেই অনুভূতিটা হয়েছে গত সপ্তাহে। যখন চিকিৎসকদের মুখে ললিতের কথা শুনে গ্রামে এসে হাজির হয়েছিল ব্রিটেনের এক দল সাংবাদিক। তার পরই রাতারাতি জগৎবিখ্যাত ললিত। ইন্টারনেটে ভাইরাল তার ছবি। ঘনঘন তার বাড়িতে সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তাদের আনাগোনা। গোটা পৃথিবীতে হাতে গোনা যে ক’জন মানুষের অতি বিরল ‘ওয়্যার উল্ফ সিনড্রোম’ বা ‘মানুষ-নেকড়ে সিনড্রোম’ রয়েছে, ললিত তাদের অন্যতম। এটি জিনের মিউটেশন-ঘটিত একটি সমস্যা। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে এই রকম মানুষের সংখ্যা একশোরও কম।

‘ওয়্যার উল্ফ সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত অনেকেই নিয়মিত ‘শো’ করতেন। যেমন (বাঁ দিক থেকে) মেক্সিকোর গায়িকা-নায়িকা জুলিয়া পাসট্রানা (১৮৩৪-১৮৬০), লাওসের ক্রাও ফারিনি (১৮৭৬-১৯২৬) এবং আমেরিকার অ্যালিস এলিজাবেথ ডরোথি (১৮৮৭-১৯৩৩)।

বেঙ্কট পাতিদারের মোবাইলে ফোন করে তার ছেলে ললিতের সঙ্গে কথা বলা গেল। স্বচ্ছন্দ ভাবে বেশ গুছিয়ে সে বলল, ‘‘আমি যে বিশেষ কেউ, সে রকম এত দিন মনেই হয়নি। শুধু রোমগুলো বড় হয়ে চোখেমুখে পড়লে একটু অসুবিধা হয়। চোখে ভাল করে দেখি না। কান ব্যথা করলে মা কানে ভাল করে ড্রপ দিতে পারে না। খাওয়ার সময় খাবারের সঙ্গে মুখে রোম চলে যায়। এখন বাইরে থেকে এসে সবাই জানাচ্ছে আমার শরীরের জিন একেবারে অন্য রকম। আমি খুব ‘স্পেশ্যাল’। আমার সঙ্গে সব ছবি নিচ্ছে।’’ ফোনের ও-পার থেকে গলায় উৎসাহ নিয়ে ললিত বলে, ‘‘আমি পুলিশ হতে চাই। ভালই হবে, আমার এই রোমের জন্য চোর-ডাকাতেরা আমাকে বেশি ভয় পাবে।’’

আরও পড়ুন: সামনে ভোট, নজরে মধ্যবিত্ত, বাড়ি ও ফ্ল্যাটের জিএসটি এক ধাক্কায় ৮ থেকে ১ শতাংশ

চিকিৎসক ও জিন বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, এই সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষেরা আসলে আধুনিক মানুষ ও তাদের পূর্বপুরুষ গুহামানবদের মধ্যে ‘মিসিং লিঙ্ক।’ সেই আদিম মানুষের জিনের মধ্যে কোনও কোনওটি এখনকার কিছু মানুষের শরীরে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে। চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের স্পষ্ট উদাহরণ এঁরা। শিশু বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘এদের অনেকের চোয়াল, হাত-পা, হাড়, দাঁতের গঠন গুহামানব বা গরিলার মতো হতে পারে।’’ প্রাচীনকাল থেকেই এই মানুষদের অস্তিত্ব ছিল এবং সম্ভবত এঁদের দেখেই মানুষ-নেকড়েদের নিয়ে নানা কল্পকথার জন্ম। চিকিৎসাবিজ্ঞানেও নথিভুক্ত রয়েছে বিভিন্ন দেশের এই রকম বেশ কিছু মানুষের নাম। ২০১৫ সালে এই রকম এক ব্রাজিলীয় কিশোরী ও ২০১৬ সালে এক বাংলাদেশি কিশোরীর খোঁজ মিলেছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন