নিশ্চিন্ত অখিলেশ, বাহুবলী খুইয়ে ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ভরসায় পদ্ম 

যে জেট এয়ারওয়েজ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে রোজ নিশানা করছেন বিরোধীরা, সেই সংস্থার ঝাঁপ বন্ধের পরে আত্মহত্যা করা প্রথম কর্মীর বাড়িতেই এমন প্রবল মোদীভক্তি? 

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

আজমগঢ় শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৯ ০৬:৪৫
Share:

মাথায় থাক: এসপি নেতা অখিলেশ যাদবকে পরানো হচ্ছে মুকুট। রবিবার উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে। এপি

প্রকাণ্ড নিম গাছটার ছায়ায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে শৈলেশ সিংহের অর্ধসমাপ্ত বাড়িটা। যার দাওয়ায় ভেজা চোখে বসে তাঁর জনা কয়েক আত্মীয়-প্রতিবেশী। কথা সামান্য এগনোর পরে লজ্জার মাথা খেয়ে বড় সন্তর্পণে সেখানেই তুলেছিলাম প্রশ্নটা— ভোটের হাওয়া কেমন? এক মুহূর্তও সময় না নিয়ে আত্মীয় রাজেশ সিংহের উত্তর এল, ‘‘মোদীজি।’’ জানা গেল, শৈলেশের বাড়ি, পাড়া এমনকি আজমগঢ় শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের এই কড়ৌধ গ্রামের সিংহ ভাগ ভোটই যাবে পদ্মের ঝুলিতে।

Advertisement

তাজ্জব! যে জেট এয়ারওয়েজ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে রোজ নিশানা করছেন বিরোধীরা, সেই সংস্থার ঝাঁপ বন্ধের পরে আত্মহত্যা করা প্রথম কর্মীর বাড়িতেই এমন প্রবল মোদীভক্তি?

ঘোর কাটার আগেই বিজেপি প্রার্থীর মুখোমুখি। ভোজপুরী ছবির জনপ্রিয় অভিনেতা-গায়ক দীনেশ লাল যাদব। আজমগঢ়ের গা-ঘেঁষা নরৌলি থেকে বেরনোর পথে তাঁর গাড়ি ছেঁকে ধরেছে জনতা। সকলেই চান হাত মেলাতে। আব্দার নিজস্বীর। প্রায় গায়ে উঠে পড়ছেন কমবয়সীরা। তাঁদের সরাতে গিয়ে দীনেশ বাঁ হাত বাড়াতেই তার উপরে কোলের বাচ্চাকে বসিয়ে দিলেন এক মা! ‘তনিক ফোটো লে লি বাবু’। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এ বার এখান থেকে এসপি প্রার্থী অখিলেশ যাদবের হার যেন সময়ের অপেক্ষা।

Advertisement

ভোট-ময়দানে কত ‘আনপড়’, টের পেলাম পরের কয়েক ঘণ্টায়। আজমগঢ়ের নাড়ি টিপতে গিয়ে।

ছোটবেলার অনেকটা এই বঙ্গের বেলঘরিয়ায় কাটানো দীনেশ যখন কেন্দ্র চষে বেড়াচ্ছেন, তখন প্রতিদ্বন্দ্বী অখিলেশের দেখা মিলল বিশাল এলইডি পর্দায়। পালোয়ান তির্‌হার কাছে সমাজবাদী পার্টির অফিসে। জোটবার্তা দিতে যার দরজায় অখিলেশ ও বিএসপি নেত্রী মায়াবতীর সমান মাপের ছবি। সঙ্গে রাফাল। সেখানে কড়ৌধের কথা তুলতেই হেসে ওড়ালেন অমিত যাদব, আদনান আহমেদ, পঙ্কজ যাদব, রেহান খানরা। মনে করালেন, এই লোকসভার অন্তর্গত পাঁচটি বিধানসভার মধ্যে তিনটি (গোপালপুর, মেহনগর ও আজমগঢ় সদর) এসপি-র দখলে। বাকি দু’টি (সাগরি ও মুবারকপুর) বিএসপির। এ বার জোট হওয়ায় নাকি হিসেব আরও সোজা। রাজ্যের বিখ্যাত জাত-রাজনীতি ‘জলবৎ তরলং’।

কী রকম?

অমিত ও রেহান বলছেন, ২০১৪ সালের হিসেবেই এ তল্লাটে যাদব ২.৬৫ লক্ষ, মুসলিম ২.৫ লক্ষ আর দলিত ৩.৮ লক্ষ। এই দলিতের মধ্যে আবার ২.৫ লক্ষ জাটভ। যাঁরা প্রতি বার চোখ বন্ধ করে ভোট দেন মায়াবতীর চিহ্ন হাতিকে। তাঁদের দাবি, এই সমস্ত ভোট এ বার পড়বে অখিলেশের ঝুলিতে। ইঙ্গিত, সাড়ে সাত লক্ষ নিশ্চিত ভোট পকেটে নিয়ে ময়দানে নামবেন মুলায়ম সিংহ যাদবের ছেলে। এর পরেও অখিলেশের জমানায় হওয়া উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে তাঁকে ভোট দেবেন ৭০ হাজার পাসি, ১৩ হাজার খটিক, ১৭ হাজার ধোবি, ২৫ হাজার তফসিলি উপজাতিদের একাংশ। কিছু ভোট আসবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ ঘর থেকেও।

এটা ঠিক, এই কেন্দ্র পরিচিত এসপি, বিএসপি-র গড় হিসেবে। নিরাপদ আসন না হলে, চট করে সেখান থেকে দাঁড়াতেন না অখিলেশের মতো ওজনদার নেতা। যিনি ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তো বটেই, এখন এসপি-র সভাপতিও। কিন্তু তা হলে গত বার এই আসনে মুলায়মের মতো ‘যাদব কুলপতি’কে মাত্র ৬৩ হাজার ভোটে জিততে হল কেন? তা-ও এই অভিযোগ কাঁধে নিয়ে যে, আসলে হেরে যাওয়া সত্ত্বেও গণনার সময়ে তাঁকে জোর করে জিতিয়ে দিয়েছিল অখিলেশের প্রশাসন?

রমাকান্ত যাদবের দীর্ঘ ছায়া এই প্রশ্নের উত্তরেই। গত বার যাদব ভোটের বড় অংশ টেনে মুলায়মকে প্যাঁচে ফেলে দিয়েছিলেন যিনি। আজমগঢ়ে যে কোনও মোড়ে কান পাতলে, এই ‘বাহুবলী’র গল্প মুখে মুখে ফেরে। তিনি এ অঞ্চলে অনেকের চোখে ত্রাস, আবার কারও কাছে ‘গরিবের মসিহা’। ভাই উমাকান্ত যাদব বিএসপির প্রাক্তন সাংসদ। ছেলে অরুণ কুমার যাদবও আজমগঢ় জেলার ফুলপুর পাওয়াইয়ের বিধায়ক। স্থানীয় বাসিন্দারাই বলছিলেন, এই ডাকাবুকো রমাকান্তকেই বরাবর ‘এমপি সাহাব’ বলে ডাকে আজমগঢ়। ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ সালে এসপির হয়ে এখানে সাংসদ হয়েছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে জেতেন বিএসপির হয়ে। ফের দল বদলে ২০০৯ সালে বিজেপির সাংসদ। আর এ বার বিজেপি টিকিট না দেওয়ায় তিনি ভদোহি থেকে কংগ্রেস প্রার্থী।

সুবিধা বুঝে প্রায় সব দলে ঘোরা সারা। এলাকায় পরিচিতি কুখ্যাত মাফিয়া হিসেবে। তাঁর নামে ক’ডজন, তার হিসেব রাখা শক্ত। তবে সারা দেশে তাঁর পরিচিতি সম্ভবত এক সঙ্গে সাত জনকে জীবন্ত পুঁতে দেওয়ার অভিযোগের কারণে! আজমগঢ়ে এই রমাকান্তই ‘এমপি সাহাব’। এই ভোটে তাই এখানে না থেকেও ভীষণ ভাবে আছেন তিনি। সুমন যাদব বলছিলেন, ‘‘ডাকাবুকো, পালোয়ান না হলে কি আর নেতা হয়!’’

তা হলে গত বার খোদ ‘নেতাজি’র সঙ্গে টক্কর দেওয়ার পরেও বিজেপি তাঁকে প্রার্থী করল না কেন? নাথু সিংহ, গোপাল চৌবে, কিরণ চৌবে, সঞ্জয় যাদবদের দাবি, এ বারও এখানে রমাকান্তকে প্রার্থী করতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। কিন্তু স্থানীয় নেতাদের আপত্তিতেই হয়নি।

রমাকান্তের অভাব আর জোটের জোর মেনেও বিজেপির আশা, বৈতরণী পার করবেন নরেন্দ্র মোদীই। বাহুবলীর কদর থাকা আজমগঢ়ে ছাতির মাপ গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ৫৬ ইঞ্চির বালাকোট হানায় মজেছেন আমজনতা। আশা করছেন, রুপোলি পর্দার গ্ল্যামারের দৌলতে যাদব ভোট টানবেন দীনেশ ওরফে নিরাহুয়াও। এখনও অখিলেশের দিকে হয়তো পাল্লা ভারী। কিন্তু শেষ বেলার মোদী ম্যাজিকে অগাধ আস্থা তাঁদের।

দিনভর চক্কর কেটেও চাকরি, কাজ, উন্নয়ন— এই সমস্ত কথা খুব কম শুনলাম। কিছু রাস্তা, চিনির কল খোলা, আজমগঢ় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব পাশ...ব্যস। স্বাধীনতার সাত দশক পেরিয়েও ব্যালট যুদ্ধের মূল মাপকাঠি জাতের জটিল সমীকরণ।

ফিরতি পথে এক মধ্যবয়স্ককে প্রশ্ন করলাম, রাফালের নাম শুনেছেন? ঘাম মুছতে মুছতে পাল্টা প্রশ্ন এল, ‘‘কৌন ভাইয়া? রাফেল যাদব?’’

দেড় দশকের সাংবাদিকতার গর্বের গালে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন