ভোটের ঢাকে কাঠি পড়লেই বিহারের রাজনীতিক থেকে সাংবাদিক— সকলেই খাতাকলম নিয়ে অঙ্ক করতে বসে যান। সে অঙ্ক জাতপাতের। গত তিন দশক ধরে জাতপাতকে বাদ দিয়ে বিহারে ভোট থেকে উন্নয়ন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কোনও কিছুই হয় না। সরল পাটিগণিতে বিভিন্ন শিবিরের নেতারা শতাংশের অঙ্কে ভোটাদাতাদের নিজেদের মতো ভাগ করে নিয়ে জয়-পরাজয়ের বিশ্লেষণ করেন।
ভারতে কমণ্ডল রাজনীতির মোকাবিলায় মণ্ডল রাজনীতির সূচনা পর্ব থেকেই বিহার-সহ হিন্দি বলয়ের সার্বিক রাজনীতি অগ্রসর এবং অনগ্রসরে দ্বিধা বিভক্ত। আশির দশকের শেষে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রাম রথ রুখে দিয়ে বিহারে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ককে নিশ্চিত করে নেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। পরের দেড় দশক এই যাদব-মুসলিম সমীকরণকে হাতিয়ার করে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে রাজ্য শাসন করেছেন। অভিযোগ, ওই সময়ে অপরাধ ও সরকারি স্তরে ঘুষের রমরমা রাজ্যে জাঁকিয়ে বসেছিল। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ (যাঁদের অধিকাংশই উচ্চবর্ণের) এই পর্বকে ‘জঙ্গলরাজ’ আখ্যা দেন।
তার ফলশ্রুতি, ২০০৫ সালে বিজেপিকে সঙ্গী করে নীতীশ কুমার বিহারে লালু জমানার অবসান ঘটান। নিজেকে ‘সুশাসনবাবু’ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার পাশাপাশি, লালুর যাদব-মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের মোকাবিলায় কুর্মি নীতীশ নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক গড়ায় মন দেন। সে ক্ষেত্রেও জাতপাতের অঙ্ক কষেই এগোন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। বিহারে জনসংখ্যার ৪৬.৯ শতাংশ অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) ভুক্ত। তার মধ্যে যাদব, কুশওয়াহা-কোয়েরি ও কুর্মি (ওয়াইকেকে) যথাক্রমে ১৪.৪, ৬.৪ এবং ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২৫.৮ শতাংশ। বাকি ১৩০টি ‘সাব-কাস্ট’ মিলে ওবিসির ২১.১ শতাংশ। সম্পদ, শিক্ষায় ও ক্ষমতায়নের দিক থেকে এই বাকি ১৩০টি সাব-কাস্টকে পিছনে ফেলে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দখল করে ওয়াইকেকে-র তিনটি জাত। নীতীশ সেই জায়গাতেই থাবা বসান। ওই ১৩০টি সাব-কাস্টকে তাঁর সরকার ‘মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট’ (এমবিসি, কেউ বলেন ইবিসি) হিসেবে চিহ্নিত করে, পঞ্চায়েত ও নগরপালিকার ভোটে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে তাঁদের ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করেন। ফলে শিক্ষা এবং চাকরি ক্ষেত্রেও তাঁরা আস্তে আস্তে এগোচ্ছেন।
একই ভাবে ১৬ শতাংশ দলিতের মধ্যে থেকে দুশাদ বা পাসোয়ানদের বাদ দিয়ে ২১টি সাব-কাস্টকে ‘মহাদলিত’ হিসেবে চিহ্নিত করে সেই ১০ শতাংশ মানুষেরও একই ভাবে ক্ষমতায়নের ব্যবস্থা করেছেন নীতীশ। লালুর মুসলিম-যাদব ভোটব্যাঙ্ককে এ ভাবেই কার্যত ভোঁতা করেছেন তিনি। বাকিটা নীতীশ সরকারের উন্নয়ন—রাস্তাঘাট, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, পানীয় জল এবং সর্বোপরি মদের উপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা। যদিও বিহারের রাজনীতিকদের একাংশ মনে করেন, এর ফলে প্রবল ভাবে উপকৃত হওয়া বিহারের গরিব মহিলাদের অবশ্য ভোটদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্বাধীনতা নেই। বাড়ির পুরুষেরাই ঠিক করেন মহিলারা কোন দলকে ভোট দেবেন। নীতীশের এই সার্বিক ‘সামাজিক কারিগরি’-র সঙ্গেই যোগ হয়েছে বিজেপির উচ্চবর্ণের ভোট। রামবিলাস পাসোয়ানের ৪ শতাংশ দুশাদ ভোট।
বিহারে বিরোধী মহাজোটের অন্যতম শরিক কংগ্রেসের এককালের নিজস্ব ভোট ব্যাঙ্ক এখন তলানিতে। এ বারের নির্বাচনে উচ্চবর্ণের কিছু ভোট তারা পেতে পারে। মুসলিমদের একটা অংশের সমর্থনও তাদের দিকে যেতে পারে। রাহুল গাঁধীর দল পেতে পারে দলিত ভোটের অংশও। কিন্তু শতাংশের অঙ্কে তা বলার মতো নয়। কংগ্রেসকে নির্ভর করতে হবে মূলত লালুপ্রসাদের আরজেডির উপরেই। কিন্তু এ বারের বিহার-ভোট ‘শিবহীন যজ্ঞ’-এর মতোই লালুহীন। আরজেডি প্রধানের অনুপস্থিতি বিরাট ফারাক তৈরি করে দিয়েছে মহাজোটের সার্বিক ভোট প্রক্রিয়ায়। খানিকটা যেন অগোছালোও। তবুও যথাসম্ভব লড়াইয়ে আছে মহাজোট।
এ বার বিহারের জাতপাতের ভোটে বাড়তি মাত্রা জুড়েছে বিজেপির ধর্ম এবং দেশপ্রেমের জিগির। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতপাতের অঙ্ককে সামান্য হলেও বদলে দেবে ধর্ম। বিজেপিরও এক নেতা একান্ত আলাপচারিতায় স্বীকার করেছেন, ভোটটাকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে দিলে তাঁদের আর নীতীশকেও দরকার হবে না।