গোডিকা গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। নিজস্ব চিত্র
কলেজে পড়ার সময় বার দুয়েক। তার পর আর কখনও সিনেমা দেখেননি ধর্মপাল। রাজ্য সরকার গত বছরে সব পঞ্চায়েত কর্তাদের ‘টয়লেট এক প্রেমকথা’ দেখাল। হরিয়ানার গোডিকা গ্রামের সরপঞ্চ ধর্মপাল উদ্দীপ্ত চিত্তে ঘোষণা করে দিলেন, শৌচালয় না থাকলে সে বাড়িতে তাঁর গ্রাম থেকে কোনও মেয়ের বিয়ে দেওয়া হবে না।
শৌচালয় তো নয়, তার নাম এখন ইজ্জত ঘর! জনস্বাস্থ্যের বদলে মেয়েদের ইজ্জতের প্রশ্নকে এগিয়ে দিয়েই রাষ্ট্র শৌচাগার গড়তে নেমেছে। ধর্মপালের স্লোগান সেখানে সুপারহিট! মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টরও ধর্মপালের কথা টুইট করেছেন।
সিরসা থেকে ঘণ্টা দেড়েকের রাস্তা গোডিকা। শস্যশ্যামলা সম্পন্ন এলাকা। আর কুড়ি কিলোমিটার গেলেই ওমপ্রকাশ চৌটালার গড়। ধর্মপাল নিজে অবশ্য মোদীজির ভক্ত। ‘‘আপনাদের গ্রাম তো অনেক বছর ধরেই শৌচালয়ে অভ্যস্ত, তাই না?’’ দিগন্তবিস্তৃত গম খেতের দিকে তাকিয়ে তৃপ্ত সরপঞ্চ বললেন, ‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের এলাকাটা আসলে খুব এগিয়ে থাকা কি না!’’ মোদী-যুগের আগেও শৌচালয় ছিল তবে!
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ছবির মতো সুন্দর মিডল স্কুলটা ঘুরে দেখে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পৌঁছে জানতে ইচ্ছে হল, লিঙ্গ নির্ণয় আর কন্যাভ্রূণ হত্যাও কি বন্ধ? ধর্মপাল হেসে বললেন, ‘‘লুকিয়েচুরিয়ে করা যায়। তবে অনেক খরচ, তাই সে পথ চট করে মাড়াচ্ছে না লোকে। তবে পুত্রসন্তানের অপেক্ষা করতে গিয়ে অনেকের পাঁচ-সাতটা মেয়ে হয়ে যাচ্ছে!’’
শৌচালয় থেকে বেটি বচাও-এ স্বাগত। লিঙ্গ-অনুপাত নামছিল হু হু করে! শুধু সরকারি ফতোয়া নয়, ঠেকায় পড়েও নিজেকে খানিক বদলাচ্ছে হরিয়ানা। গোঁড়ামি আর উন্মুক্তির মাঝরাস্তায় যেন দাঁড়িয়ে আছে রাজ্যটা। নইলে কি আর খাপ পঞ্চায়েত মহিলা শাখা খোলে! ২০১০ থেকে সর্বজাতীয় সর্বখাপ মহিলা মহাপঞ্চায়েত-এর প্রেসিডেন্ট সন্তোষ দাহিয়া। বেশির ভাগ গ্রামই গোত্রভিত্তিক এক-একটা খাপের আওতায়। সেখানে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব কোথায়? প্রশ্নটা তুলেছিলেন সন্তোষ। তিনিই বললেন, খাপ মহিলা শাখা কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে ২০১২ থেকেই সচেতনতা অভিযান চালাচ্ছে। গ্রামে গ্রামে গিয়ে বলছে, মেয়েদের অন্তত বারো ক্লাস অবধি অবশ্যই পড়াও। ঘুঙ্ঘট হঠানোর ডাকও দিয়েছেন তাঁরা। কুরুক্ষেত্রের পিপলি হরিয়ানার প্রথম ঘুঙ্ঘট-মুক্ত গ্রাম হয়েছে। এখন সবচেয়ে বড় খাপ, মালিক গাঠওয়াড়া-ও হাওয়া বুঝে বলছে, ঘুঙ্ঘট দরকার নেই।
আর ‘অনার কিলিং’? যার সঙ্গে প্রায় সমার্থক হয়ে প়ড়েছিল খাপের নাম? সন্তোষ বললেন, ‘‘খাপের নামে এটা অপপ্রচার। খাপ ও রকম ফতোয়া দেয় না।’’ ‘‘ঘটনাগুলো যখন ঘটে, তখন এগিয়ে এসে নিন্দা করে কি?’’ পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন জগমতী সাঙ্গোয়ান— নারী আন্দোলন, বাম আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী।
রোহতক শহরের মধ্যিখানে রাস্তার এক পাশে এসএসপি-র অফিস, এক পাশে মেয়েদের সরকারি কলেজ। পিছনে মহিলা থানা। দু’পা হাঁটলে জেলা আদালত। এই রকম একটা চত্বরে দিনদুপুরে মমতা নামে এক তরুণী আর তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ অফিসার দু’জনেই খুন। বাল্মীকি ছেলেকে বিয়ের মাসুল। আর্যনগর থানার খাতায়, যার সংক্ষিপ্ত নাম ২৩৬ নম্বর মামলা।
মোখরার ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তালিম নিচ্ছে এই মেয়েরা। নিজস্ব চিত্র
গত বছর মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়েতে কোনও ভাবে নাক গলানো যাবে না। ইজ্জতের নামে খুনের ঘটনা ঘটলে জেলাশাসককে কৈফিয়ত দিতে হবে। তার পরই অগস্ট মাসে মমতা হত্যাকাণ্ড। ঘটনাটা জানতে চাইতেই সাবইনস্পেক্টর বলে ওঠেন, ‘‘ছেলেটা মোটেই ভাল ছিল না, মেয়ের বয়সের প্রমাণপত্র ভাঁড়িয়েছিল!’’ ঘটনাটা অনার কিলিং নয় বলছেন? ‘‘এটা ক্লাস ফ্যাক্টরের ব্যাপার!
ছেলে একে নিচু জাত! পয়সাওয়ালাও নয়! মেয়ের বাড়ি মানবে কী করে?’’ পুলিশের বক্তব্য, পরিবারই খুন করেছে নিজের সিদ্ধান্তে। এখানে খাপ নেই।
তাই? জগমতী জানালেন, শ্বশুরবাড়ি যখন পুত্রবধূকে দাহ করতে চাইল, তখন খাপ ফতোয়া দিল, ‘নিচু’ জাতের ঘরে ‘উঁচু’ জাতের দাহ হবে না! জগমতীরাই লোকজন জোগাড় করে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে দাহ করান। বললেন, ‘‘অনার কিলিং আটকানোর জন্য বিশেষ আইন করার কথা হয়েছিল। মোদী সরকার নড়েই বসল না। বসবে কী করে? গতবার লোকসভা ভোটে মোদী এখানে প্রচার শুরুই করলেন ‘খাপভূমি কো নমন করতা হুঁ’ বলে!’’ তবে হ্যাঁ, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর খাপ নেতৃত্ব মুখে বলা শুরু করেছেন, ভিন জাতে বিয়েতে নাকি আপত্তি নেই। স্বগোত্র আর স্বগ্রামে বিয়ে না হলেই হল।
‘‘দেখুন, স্বগোত্রে বিয়ে না করার কথাটা কিন্তু পুরোপুরি ‘বিজ্ঞানভিত্তিক’। আর গ্রামের মেয়ে মানে তো বোনের মতো, বিয়ে হয় কী করে?’’ হাঁটতে হাঁটতে বলছেন তরুণ সরপঞ্চ প্রদীপ। প্রবীণরা গড়গড়ায় টান দিতে দিতে তাস খেলায় ব্যস্ত। গ্রামের নাম মোখরা।
রোহতক থেকে আসার সময় দয়ানন্দ সরস্বতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ‘বেটি পড়াও’ লেখা গুটিকয় বাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। বিজেপি সমর্থক প্রদীপ নিজে থেকেই বললেন, মাহেম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ১২টা বাস দিয়েছেন। নিখরচায় মেয়েদের গ্রাম থেকে কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দিচ্ছে, ছুটি হলে ফিরিয়ে আনছে। যে সব পরিবার মেয়েদের শহরে পাঠাতে ভয় পেত, তারা এখন নিশ্চিন্ত।
‘বেটি’দের জন্য গ্রামের বুকেও কিন্তু একটা জায়গা আছে— মুক্তির, সাম্যের, সংকল্পের। সেখানে পৌঁছতে গেলে আর একটু হাঁটতে হবে। বীজ ভাণ্ডার পেরিয়ে, গ্যাস সিলিন্ডার বিতরণ কেন্দ্র ছাড়িয়ে টলটলে পুকুরটা ডান হাতে রেখে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে হবে। সে এক লাল-নীল ভূখণ্ড। সেখানে পাকা ছাদের নীচে লাল-নীল ম্যাট আর সারি সারি লাল-নীল রেসলিং গ্লাভস। মোখরার ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এই মুহূর্তে ছেলেদের সঙ্গে তালিম নিচ্ছে কুড়িটিরও বেশি মেয়ে। শিক্ষকরা জান দিয়ে খাটছেন, সকলকে চোখের মণির মতো আগলাচ্ছেন। গোটা গ্রাম তাকিয়ে আছে, কবে ওরা মেডেল আনবে! অনেকেরই চুল ছাঁটা, পরনে ট্র্যাকস্যুট। প্রদীপ মজা করে বললেন, ‘‘ছেলে না মেয়ে বলুন দেখি, বুঝতে পারেন কি!’’
জাঠভূমির মন কি তবে বদলে দেবে খেলাধুলোই? ডাকাবুকো চেহারার হরিয়ানভি মেয়েরা তো খেতখামারের কাজে চিরকাল হাড় ভাঙা মেহনত করেছে। খেলার মাঠে পারদর্শিতা তাদের মজ্জাগত। খেলাধুলোর চর্চাও এখানে বরাবরের। মেয়েদের অংশগ্রহণও নতুন নয়। কিন্তু গীতা-ববিতা ফোগত আর সাক্ষী মালিকের সাফল্য ইদানীং একটা নতুন স্বপ্ন চারিয়ে দিয়েছে রাজ্য জুড়ে। উপহার দিয়েছে নতুন আইকন। তার ধাক্কায় আপনিই ভেঙে যাচ্ছে অনেক বেড়া। স্কুলের দেয়ালে লেখা হচ্ছে, ‘‘অপনি পেয়ারি বেটিয়োঁ কো জিনে কা অধিকার দো, সিন্ধু-সাক্ষী-কল্পনা বনে, অ্যায়সে তুম সংস্কার দো!’’
বলা হয়নি, মোখরা-ই কিন্তু সাক্ষীর আদি বাড়ি, তাঁর নিজের গ্রাম! ইজ্জতের শেকল আর আকাঙ্ক্ষার হাতছানির মধ্যে দঙ্গল চলছে সেখানে।
ফাইট হরিয়ানা, ফাইট!