PM Modi in Bengal

৭৫ মিনিটের সভা সারতে হল ১৬ মিনিটে! এসআইআর নিয়ে মতুয়া-উদ্বেগে নীরব প্রধানমন্ত্রী, তবে ‘দাদা’ থেকে ‘বাবু’ বঙ্কিম

এসআইআর নিয়ে মতুয়া এলাকায় যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তার নিরসনে প্রধানমন্ত্রী বার্তা দেবেন বলে শমীক আভাস দিয়েছিলেন নিজের ভাষণে। কিন্তু মোদীর ভাষণে তেমন কিছু শোনা যায়নি।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:৩৩
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সভা মিলিয়ে অন্তত ৭৫ মিনিট নদিয়ার তাহেরপুরের দুই মঞ্চে থাকার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। কিন্তু আবহাওয়া বাম! পশ্চিমবঙ্গ সফর তাঁকে সেরে ফেলতে হল ১৬ মিনিটে! তা-ও কলকাতা বিমানবন্দরে বসে ফোনে ভাষণ দিয়ে।

Advertisement

মোদীর শনিবারের সভা থেকে বিধানসভা ভোটের প্রচারের শিঙা বাজিয়ে দেওয়া হবে, এমনই পরিকল্পনা ছিল রাজ্য বিজেপির। কিন্তু আবহাওয়া বিভ্রাটে গোটা পরিস্থিতিটাই গোলমেলে হয়ে যায়। তাহেরপুরের জনসভায় অপেক্ষা করছিল বিশাল ভিড়। মঞ্চে অপেক্ষা করছিলেন রাজ্য বিজেপির তাবড় নেতারা। কিন্তু মোদী তাঁদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতেই পারলেন না। তাহেরপুরের জমায়েত মোদীকে দেখতে পায়নি। শুধু গলা শুনেছে। ভাষণের শুরুতেই অবশ্য সে বিষয়ে মোদী ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। সভাস্থলে যাওয়ার পথে যে বিজেপি কর্মীরা রেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন এবং আহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবাকে সমবেদনাও জানান।

কিন্তু সে ঘোলে দুধের স্বাদ যে মেটেনি, তা বলা বাহুল্য। রাজ্য বিজেপির নেতারা যে ‘আশাহত’, তা তাঁরা গোপন করেননি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার যেমন বলেছেন, ‘‘আবহাওয়া খারাপ থাকায় প্রধানমন্ত্রী তাহেরপুরে পৌঁছতে পারেননি। তাতে আমরা কষ্ট পেয়েছি। আমাদের কর্মীরাও আশায় ছিলেন।’’ তবে পাশাপাশিই সুকান্ত জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীকে তাঁদের মধ্যে আবার পাওয়ার আশা তাঁরা ছাড়েননি। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলে গিয়েছেন যে, তিনি আবার আসবেন এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নদিয়ার মাটিতে, নদিয়ার মানুষের মাঝেই আসবেন। ফলে তাঁকে শীঘ্রই আবার আমরা নদিয়াতেই পাব বলে আশা রাখছি।’’

Advertisement

তাহেরপুরে সভামঞ্চে উপস্থিত বিজেপি নেতারা। —নিজস্ব চিত্র।

ঘটনাচক্রে, এর আগেও একাধিক বার আবহাওয়ার কারণে বিজেপি নেতাদের পশ্চিমবঙ্গ সফর ব্যাহত হয়েছে। একবার অমিত শাহ শিলিগুড়ি পৌঁছোতে পারেননি। মোদী নিজে একবার বাগডোগরা থেকে সিকিম যেতে পারেননি। সে বারেও তাঁকে বাগডোগরা থেকে মোবাইলে ভাষণ দিতে হয়েছিল। শনিবারও তেমনই ঘটল। ঘন কুয়াশার কারণে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে রওনা দিয়েও তাহেরপুরে অবতরণ করতে পারেনি মোদীর হেলিকপ্টার। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আবার কলকাতা বিমানবন্দরেই ফিরে আসে সেটি।

জল্পনা ছড়িয়েছিল, অতঃপর প্রধানমন্ত্রী সড়কপথে তাহেরপুরে যাবেন কি না। কিন্তু তা-ও শেষপর্যন্ত হতে পারেনি। কারণ, নদিয়া থেকে আকাশপথে কলকাতায় ফিরে মোদীর যাওয়ার কথা ছিল গুয়াহাটিতে। সেখানকার বিমানবন্দরের নবনির্মিত টার্মিনালের উদ্বোধন করতে। তাহেরপুরে সড়কপথে যাতায়াত করলে সেই কর্মসূচিও পিছিয়ে যেত। শেষমেশ কলকাতা বিমানবন্দরে বসেই ফোনে ভাষণ দেন মোদী। বক্তব্য শেষ করে দেন ১৬ মিনিটেই। যান্ত্রিক কারণে সেই সংক্ষিপ্ত ভাষণেও দু’তিন বার সাময়িক ‘বিরতি’ চলে আসে।

রাজ্য বিজেপির আশা ছিল মতুয়া সমাজে তৈরি হওয়া ‘এসআইআর-উদ্বেগ’ নিয়ে বার্তা দেবেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মোদীর সংক্ষিপ্ত ভাষণে সে প্রসঙ্গে কোনও আশ্বাসবাণী শোনা যায়নি। মতুয়া প্রসঙ্গে মোদী শুধু বলেছেন, ‘‘সমাজকল্যাণের ভাবনাকে মতুয়া সমাজ চিরকাল এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। হরিচাঁদ ঠাকুর কর্মের মর্ম দেখিয়েছিলেন, গুরুচাঁদ ঠাকুর কলম ধরিয়েছিলেন, বড়মা মাতৃত্ব বর্ষণ করেছেন। তাঁদের প্রত্যেককে আমার প্রণাম।’’ আর বলেছেন, ‘‘যাঁরা আমাদের নিজেদের মানুষ, যাঁরা নির্যাতিত, যাঁরা শরণার্থী, তৃণমূল তাঁদের উপর অত্যাচার করে। সিএএ-র মাধ্যমে আমরা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিচ্ছি, তৃণমূল মিথ্যা প্রচার করে তাঁদের ভয় দেখাচ্ছে।’’ সভায় প্রধানমন্ত্রীর অব্যবহিত আগের বক্তা ছিলেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। তিনি ভাষণে আভাস দিয়েছিলেন, এসআইআর নিয়ে মতুয়া এলাকায় যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তার নিরসনে প্রধানমন্ত্রী বার্তা দেবেন। সে ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি।

তবে পশ্চিমবঙ্গে এসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ‘বঙ্কিমদা’ বলার ভ্রান্তি শুধরে নিয়েছেন প্রদানমন্ত্রী। বাংলা এবং বাংলা ভাষা চিরকাল ভারতের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে এসেছে বলে মন্তব্য করে মোদী বলেন, ‘বন্দে মাতরম’ গান তার অন্যতম নিদর্শন। সেই সূত্রেই মোদী বলেছেন, ‘‘এই মাটি দেশকে দিয়েছে বঙ্কিমবাবুর মতো মহান ঋষিকে। ঋষি বঙ্কিমবাবু পরাধীন ভারতে বন্দে মাতরমের মাধ্যমে নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছিলেন।’’

উন্নয়ন বনাম ‘মহাজঙ্গলরাজ’

বন্দে মাতরমের সূত্র ধরেই মোদী উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রবেশ করেন। তিনি বলেন, ‘‘উনিশ শতকে বন্দে মাতরম ছিল দাসত্ব থেকে মুক্তির মন্ত্র। একুশ শতকে বন্দে মাতরমকে আমাদের রাষ্ট্র নির্মাণের মন্ত্র বানাতে হবে। এখন বন্দে মাতরমকে আমাদের বিকশিত ভারতের প্রেরণা বানাতে হবে। এই গানের মাধ্যমে বিকশিত পশ্চিমবঙ্গের চেতনা জাগবে।’’ ১৬ মিনিট ভাষণের আট মিনিটই মোদী ব্যয় করেছেন উন্নয়ন প্রসঙ্গে। বিহার বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি তথা এনডিএ-র সাম্প্রতিক জয়ের কথা উল্লেখ করে দাবি করেছেন, উন্নয়নের কারণেই ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও বিহারে বিজেপি ‘প্রচণ্ড জনমত’ পেয়েছে। তার পরে বলেছেন, ‘‘বিহারে জয়ের পরে আমি বলেছিলাম, গঙ্গা বিহার হয়েই পশ্চিমবঙ্গে আসে। তাই বিহারের ফল পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির জয়ের রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে।’’ মোদীর কথায়, ‘‘বিহার জঙ্গলরাজকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ বার পশ্চিমবঙ্গে যে মহাজঙ্গলরাজ চলছে, তা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের সব গ্রাম, শহর, গলি, মহল্লা বলছে— (বাংলায়) বাঁচতে চাই, বিজেপি তাই।’’

এক বার সুযোগ দিন!

আগের মতোই মোদীর মুখে একাধিক বার শোনা গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার গঠনের কথা। তিনি বলেছেন, ‘‘তৃণমূল মোদীর বিরোধিতা করতে চায়, করুক। একশো বার করুক, হাজার বার করুক। বিজেপির বিরোধিতা করতে চাইলেও বার বার করুক। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন কেন আটকে রাখা হচ্ছে!’’ তৃণমূলকে লক্ষ্য করে মোদী বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে কষ্ট দেবেন না। তাঁদের অধিকার কেড়ে নেবেন না। তাঁদের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার পাপ করবেন না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের সচেতন জনগণের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, একবার বিজেপিকে সুযোগ দিয়ে দেখুন। একবার এখানে বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকার গড়ে দেখুন। দেখবেন, কত দ্রুত আমরা পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন করি।’’

প্ল্যাকার্ড হাতে বিজেপি সমর্থকেরা। —নিজস্ব চিত্র।

তুলনায় ত্রিপুরা

শুধু বিহার নয়, ত্রিপুরার উদাহরণ টেনেও পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য বিজেপি সরকারের ‘প্রয়োজনীয়তা’ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘পাশের রাজ্য ত্রিপুরাকে দেখুন। লাল ঝান্ডাওয়ালারা ৩০ বছর ধরে ত্রিপুরাকে ধ্বংস করেছিল। ত্রিপুরার মানুষ আমাদের সুযোগ দিয়েছে। আমরা মানুষের স্বপ্ন অনুযায়ী ত্রিপুরাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গেও লাল ঝান্ডা থেকে মুক্তি মিলেছিল। আশা ছিল, এ বার ভাল কিছু হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বামেদের সব খারাপ দিক এবং খারাপ লোকজনকে তৃণমূল গ্রহণ করেছে। ফলে সমস্যা আগের চেয়েও বেড়েছে। তাই ত্রিপুরা দ্রুত এগোলেও পশ্চিমবঙ্গ এগোতে পারছে না।’’

গো ব্যাক

নদিয়া জেলায় জাতীয় সড়কে শনিবার বেশ কিছু ‘গো ব্যাক মোদী’ লেখা ব্যানার দেখা গিয়েছে। হেলিকপ্টার বিভ্রাটে মোদীকে শেষমেশ সড়কপথে তাহেরপুর যেতে হলে সেই ব্যানার তাঁর নজরে পড়ার সম্ভাবনাও ছিল। চোখে না-পড়লেও ওই ব্যানারের কথা তাঁর কানে যে এসেছে, তা বুঝিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘গণতন্ত্রে হার-জিত থাকেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ‘গো ব্যাক মোদী’ বলা হচ্ছে। কিন্তু তারা ‘গো ব্যাক ঘুসপেটিয়া (অনুপ্রবেশকারী)’ বলতে পারছে না। যে অনুপ্রবেশকারীরা পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে চায়, তারাই তৃণমূলের সবচেয়ে প্রিয়। এটাই তৃণমূলের আসল মুখ।’’ অনুপ্রবেশকারীদের বাঁচাতেই তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর-এর বিরোধিতা করছে বলেও মোদী মন্তব্য করেছেন।

আবহাওয়া-রাজনীতি

ভাষণের শেষে আবহাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে নাম না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করেছেন মোদী। বলেছেন, ‘‘আমি সেই নেতাদের মধ্যে নই, যাঁরা আবহাওয়াকেও রাজনীতির রং দেন। আবহাওয়া কখনও কখনও সমস্যার কারণ হয়। আগেও এমন হয়েছে আমি জানি। কিন্তু আমি তা নিয়ে রাজনীতি করিনি।’’ প্রসঙ্গত, আবহাওয়ার কারণে কোনও নির্দিষ্ট সফরে হেলিকপ্টার বা বিমান নামতে না-পারার ঘটনা মমতার ক্ষেত্রে ঘটেছে। তখন মমতা তার নেপথ্যে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছিলেন। নাম না-করে মোদী তারই জবাব দিয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে।

জয় নিতাই

ভাষণের শেষ আবহাওয়া রাজনীতি দিয়ে। শুরু ‘জয় নিতাই’ বলে। নদিয়া বৈষ্ণব আন্দোলনের পীঠস্থান। ফলে ‘জয় নিতাই’ বলে ভাষণ শুরু করেছিলেন মোদী। চৈতন্য মহাপ্রভুর কর্মকাণ্ডের জয়গানও শোনা গিয়েছে তাঁর ভাষণে। জনপ্রিয় লোকগানের পঙ্‌ক্তি, ‘হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার একলা নিতাই’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘এই ভাবনা এখনও এখানকার মাটিতে, এখানকার জলহাওয়ায়, এখানকার জনমনে জীবিত।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement