রাজীব গাঁধী মেমোরিয়ালে মহম্মদ হোসেন (ইনসেটে)। —নিজস্ব চিত্র।
চাঁদি ফাটা রোদ। তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ একটি শিশুর মাথায় হাত রেখে কিছু বোঝাচ্ছেন। সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলে চলেছেন অনর্গল।
পাশ কাটিয়ে এগোনোর সময়ে কানে এল, কর্তব্যরত পুলিশ কর্মী পাশের জনকে বলছেন, ‘‘এই লোকটার এনার্জি আছে বটে! প্রতি মাসে তিন-চারবার কাউকে না কাউকে এখানে আনবেই, আর একই ভাবে একই ঘটনার কথা বলে যাবে।’’ থমকে দাঁড়াতেই হল। কারণ, জায়গাটা শ্রীপেরুমবুদুর। আর কথা হচ্ছে রাজীব গাঁধী মেমোরিয়ালে দাঁড়িয়ে।
১৯৯১ সালের ২১শে মে ঠিক এর কয়েকশো গজ দূরে মা ইন্দিরা গাঁধীর মূর্তিতে মালা দিয়েছিলেন রাজীব। তার পরে এগিয়ে গিয়েছিলেন মূল সভাস্থলের দিকে। এর কিছু ক্ষণের মধ্যেই মানব বোমা বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর দেহ। তামিল টাইগারদের নিখুঁত ছকের আক্রমণে কেঁপে উঠেছিল গোটা দেশ।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
যে জায়গায় রাজীবের মৃত্যু হয়েছিল, ১৯৯৪ সালে সেখানেই শুরু হয় স্মৃতি উদ্যানের কাজ। তৈরি হয় রাজীব গাঁধী মেমোরিয়াল। পুলিশি পাহারা পেরিয়ে সেখানে ঢুকতে হয়। প্রতিদিনই কিছু মানুষ ঘুরে যান এই স্মৃতি উদ্যানে। কিন্তু এই বৃদ্ধ কেন মাঝেমধ্যেই ছুটে আসেন?
প্রশ্নটা করতেই থমকালেন কয়েক মুহূর্ত। মাথার ফেজ টুপিটা খুলে কয়েক বার হাত চালালেন চুলে। তার পরে বললেন, ‘‘না এসে পারি না। চোখের সামনেই তো ঘটেছিল সবটা। ওই সভায় তো আমিও ছিলাম। পরের প্রজন্ম জানুক সবটা।’’
তাঁর সঙ্গের শিশুটি তত ক্ষণে হাত ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে খানিকটা দূরে। বৃদ্ধ একপাশে বসে পড়ে বললেন, ‘‘সে দিন ওই মানুষটাকে ছিন্নভিন্ন হতে দেখেছিলাম। আর আজ নিজের দেশটাকে ছিন্নভিন্ন হতে দেখছি।’’
নাম— মহম্মদ হোসেন। বয়স ৬৫। পেশায় মোগলাই রেস্তরাঁর বাবুর্চি। ওই ঘটনার ঠিক দু'সপ্তাহের মাথায় তাঁর বিয়ের দিন ঠিক ছিল। হোসেন বললেন, ‘‘আমার বয়স তখন ৩৭ বছর। বিয়ে করব না ঠিক করে ফেলেছিলাম। বাড়ির লোকের অনেক জোরাজুরিতে শেষে রাজি হই। কিন্তু ঠিক তার আগেই এই ঘটনা। বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। বলেছিলাম, এখনই বিয়ে করা সম্ভব নয়। আগে মনটাকে ঠিক করতে হবে।’’
ফিরে গেলেন অতীতে। ‘‘আমার বউয়ের নাম হাসিনা। ওর বাড়ি গিয়ে সবটা বললাম। হাসিনাও কেঁদে ফেলল। ওই মানুষটাকে তো ও কম শ্রদ্ধা করত না। বলল, বিয়েটা ক'দিন পরেই হোক।'’ এর ছ'মাস পরে বিয়ে করেন হোসেন।
তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে ডিএমকে-এডিএমকে, তাদের নিজস্ব খেয়োখেয়ি—এ সব কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না এই বৃদ্ধ। তাঁর কথায়, ‘‘আমি বরাবর কংগ্রেসের সমর্থক। দলটাকে ভালবেসেছি। দেশটাকে ভালবেসেছি। মোদির জমানায় এই দেশে নিজেকে বড্ড পরবাসী বলে মনে হয়। তাই তামিলনাড়ুতে কী হল, তার চেয়েও বড় চিন্তা দেশে এ বার কী হতে চলেছে।’’
রাজীব গাঁধীর মৃত্যুর পরে স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তিতে পড়েছিল ডিএমকে। কারণ, তামিল টাইগারদের প্রতি ডিএমকে প্রধান করুণানিধির সহানুভূতির কথা বহুচর্চিত। ’৯১ এ রাজীবের মৃত্যুর পরে বিধানসভা ভোটে এডিএমকে-কংগ্রেস জোট আছড়ে নামিয়েছিল ডিএমকে-কে। প্রায় প্রত্যেক সভায় কংগ্রেস নেতারা বলতেন, ডিএমকে-র হাতে রাজীবের রক্ত লেগে রয়েছে।
যদিও রাজনীতির নিয়মে ডিএমকে-ই পরে কংগ্রেসের জোটসঙ্গী। হোসেন বললেন, ‘‘এটা আমি আগেও মানতে পারিনি। এখনও পারি না।’’ চোয়াল শক্ত হয় তাঁর। বলেন, ‘‘দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে অনেকে। সেটা দেখতে বড় কষ্ট হয়।’’ চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।
শ্রীপেরুমবুদুরে এবার ডিএমকে প্রার্থী টি আর বালু। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাট্টালি মাক্কাল কাটচি (পিএমকে) প্রার্থী এ ভৈথিলিঙ্গম। এই আসনটি এবার পিএমকে-কে দিয়েছে এডিএমকে। ২০১৪-র নির্বাচনে ওই আসন থেকে জিতেছিলেন এডিএমকে প্রার্থী কে এন রামচন্দ্রন। তার আগে ২০০৯ সালে এখান থেকে জেতেন বালু। এবারেও তিনি আশাবাদী। চষে ফেলছেন গ্রামের পর গ্রাম। বললেন, ‘‘বিজেপি বাইরে থেকে রাজ্যটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, এটা এখানকার মানুষ মেনে নেবেন না। তাই ডিএমকে-ই আসবে। রাজ্যের সর্বত্র।’’ পিএমকে-র ভৈথিলিঙ্গম অবশ্য বালুর আশাকে ‘দিবাস্বপ্ন’ বলে মনে করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এডিএমকে এই আসনটা তো শুধু শুধু আমাদের দেয়নি। জেতা নিশ্চিত বলেই দিয়েছে।’’
বেলা বাড়ে। রাজীব গাঁধী মেমোরিয়ালে বাড়তে থাকে দর্শকের ভিড়। ভোট দেবেন তো? ম্লান হাসেন। স্বগতোক্তির মতো হোসেন বলেন, ‘‘ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ের জীবন এক মুহূর্তে বদলে গিয়েছিল সে দিন।’’ বোঝা গেল, রাহুল-প্রিয়ঙ্কার কথা বলছেন। বললাম, ওঁরা তো বাবার হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন!
জ্বলে উঠল বৃদ্ধের চোখ। ‘‘আমি ক্ষমা করিনি।’’
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপরে বললেন, ‘‘প্রিয়ঙ্কা সেই রাজনীতিতে এলেন। কিন্তু অনেক দেরি করে। ওঁকে সামনে পেলে হাত দুটো ধরে বলতাম, বেটি, দেশটাকে বাঁচাও।’’ ঝলসানো রোদ ঠিকরে পড়ছে অদূরে জাতীয় পতাকায়। সে দিকে তাকিয়ে হোসেন বিড়বিড় করে চলেন, ‘‘দেশটা তো আমারও। আমার দেশ...।’’