নাম তামিলার কাচ্চির দফতরে প্রভাকরণের ছবি। —নিজস্ব চিত্র
রাস্তার পাশে কমলা-হলুদ বাড়ির গায়ে লাগানো সবুজ বোর্ডে চোখটা আটকে গেল। বোর্ডে জংলা সামরিক পোশাক পরা এক ব্যক্তির ছবি। কোনও ভুল হওয়ার নয়। এ তো শ্রীলঙ্কার এলটিটিই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের ছবি! ভোটের বাজারে তাঁর ছবি দেখে সটান ঢুকলাম বাড়ির ভিতরে।
সেখানে কথা বলে জানা গেল, বাড়িটি তামিলনাড়ুর একটি রাজনৈতিক দল ‘নাম তামিলার কাচ্চি’ বা এনটিকে-র। দলের বর্তমান প্রধান সিমানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তামিল টাইগার প্রভাকরণের আদর্শ মেনেই তাঁর দল। তাঁরা তামিল স্বাভিমানের কথা বলেন। প্রভাকরণ নিহত হওয়ার ন’বছর পরও, স্বাধীন তামিল রাষ্ট্রের স্বপ্ন ফেরি করে সিমানের দল। তাই দলীয় প্রতীক থেকে শুরু করে দলীয় পতাকা সব জায়গাতেই প্রভাকরণের এলটিটিই-র প্রভাব। দলের পতাকা লাল, তার মধ্যে গর্জনরত বাঘের ছবি। দলীয় প্রতীকেও গর্জনরত বাঘের দু’পাশে কোনাকুনি দু’টি বন্দুকের ছবি। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে, তামিলনাড়ু নয়, খাস প্রভাকরণের জাফনায় পৌঁছে গিয়েছি।
সিমানের দাবি, চোল রাজাদের আমলে তামিল জাতি পৌঁছেছিল উন্নতি এবং সমৃদ্ধির চূড়ান্ত উচ্চতায়। তামিল জাতিকে সেই সুবর্ণযুগে নিয়ে যাওয়াই তাঁর দলের লক্ষ্য। খাতায় কলমে তাঁর দলের প্রতিষ্ঠা ২০১০ সালে হলেও, সিমান তা মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, ১৯৫৮ সালে আদিথানারের প্রতিষ্ঠিত ‘উই দ্য তামিলস’ দলেরই নাম পরিবর্তন হয়ে ‘নাম তামিলার কাচ্চি’ হয়েছে। আদিথানার শ্রীলঙ্কার তামিল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম তামিল দেশের স্বপ্ন দেখতেন। তত্কালীন মাদ্রাজের নাম পরিবর্তন করে তামিলনাড়ু করার জন্যও তিনি আন্দোলন করেছিলেন।
এ বছর সিমানের দল তামিলনাড়ু এবং পুদুচ্চেরি মিলিয়ে ৪০টি লোকসভা আসনেই প্রার্থী দিয়েছে। ২০১১ সাল থেকে সমস্ত নির্বাচনেই রাজ্যের সব কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছে নাম তামিলার কাচ্চি। সিমানের দলেরই প্রার্থী তামিল সিনেমার জনপ্রিয় খলনায়ক মনসুর খান। মধ্য তামিলনাড়ুর মালভূমি এলাকা ডিন্ডিগুল থেকে এ বার তিনি প্রার্থী।
আরও পড়ুন: ইভিএমে কারচুপি! ফেরাতে হবে ব্যালট, সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে ২০ দলের বিরোধী জোট
ডিন্ডিগুল জেলা শহর থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে মুড়াচতুরমা নামে একটি গ্রামে দেখা মিলল মনসুরের। জনসংযোগের পাশাপাশি মিনিট দশেকের ভাষণও দিলেন তিনি। সঙ্গে থাকা একটি তামিল খবরের কাগজের সাংবাদিক বন্ধুর করে দেওয়া তর্জমায় তাঁর ভাষণের মুল কথা, ‘‘বিজেপি থেকে শুরু করে কংগ্রেস কোনওটাই দ্রাবিড় ভূমের দল নয়। ওই সমস্ত দলের নীতি তামিল স্বাধিকার এবং স্বাভিমানের বিরোধী। আর সেই দলগুলোর সঙ্গেই হাত মিলিয়েছে ডিএমকে, এডিএমকে-র মত রাজ্যের বাকি দলগুলো। তাঁর অভিযোগ, রাজ্যের কোনও দলই তামিলদের স্বার্থ দেখছে না। তাই তামিলদের স্বার্থে প্রভাকরণের মতো তামিল বাঘের আদর্শে চলা নাম তামিলার কাচ্চিকেই ভোট দেওয়া উচিত।” বক্তব্যের শেষ হতেই জোরদার হাততালি। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ‘‘প্রভাকরণই ছিলেন সাচ্চা তামিল নেতা।”
ভোটের প্রচারে এনটিকে প্রার্থী এবং তামিল ছবির জনপ্রিয় খলনায়ক মনসুর খান। —নিজস্ব চিত্র
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী হত্যার মূল কারিগর প্রভাকরণকে সন্ত্রাসবাদী বলতে নারাজ মনসুর। তাঁর কাছে তিনি আদর্শ। তাই ‘নাম তামিলার কাচ্চি’ রাজীব হত্যায় জেলবন্দি অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড রদের দাবি জানায়। সাংবাদিক বন্ধু ফেলিক্সের কাছ থেকে জানতে পারলাম কোনও নির্বাচনে দু’শতাংশের বেশি ভোট না পেলেও, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা তামিলদের সাহায্যে ওই দলের তহবিল বেশ ভাল। শুধু তাই নয়, অনেক মানুষের সমর্থনও রয়েছে। ফেলিক্সের ভাষায় এখনও তামিল স্বাভিমান গুরুত্ব পায় এ রাজ্যের মানুষের কাছে।
আরও পডু়ন: গরিবদের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ, মোদীর প্রতিশ্রুতিকে কটাক্ষ করে ডাবস্ম্যাশ ভিডিয়ো লালুর
আর তাই রাজ্যের সবক’টা দলকেই তামিল স্বার্থ বিরোধী এবং প্রবঞ্চক বলে নিশানা করলেও, ‘নাম তামিলার কাচ্চির’ আদর্শের বিরুদ্ধে কাউকেই বিশেষ চোখা আক্রমণ করতে দেখা যায় না। বিদায়ী সাংসদ এম উদয়াকুমার বলেন, ‘‘ডিএমকে নিজেও তো প্রভাকরণ আর এলটিটিই-কে সামনে রেখে এক সময় নির্বাচন জিতেছে।” তিনি পুরনো প্রসঙ্গ তুলে এনে বলেন, ‘‘আন্নাই (এম করুণানিধি) নিজে তো ছিলেন প্রভাকরণের সমর্থক। তিনি তো সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন। তার প্রমাণ তো দিয়ে দিয়েছে ভাইকো।” কয়েক বছর আগেই ২০১৬ সালে করুণানিধির এক সময়ের ঘনিষ্ঠ, বর্তমানে ডিএমকে-কংগ্রেস জোটের সদস্য এমডিএমকে প্রধান ভাইকো বোমা ফাটিয়েছিলেন। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কায় গিয়ে খোদ প্রভাকরণের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। সেখানে প্রভাকরণ তাঁকে করুণানিধিকে লেখা একটি চিঠিও দেন। সেই চিঠিও সেই সময়ে সংবাদ মাধ্যমের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ভাইকো। ডিন্ডিগুলে এ বারের ডিএমকে প্রার্থী পি ভেলুস্বামী পাল্টা বলেন, ‘‘তামিল রাজনীতির সবাই জানেন এক সময় এইআইএডিএমকে প্রতিষ্ঠাতা এম জি রামচন্দ্রন কী ভাবে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এলটিটিই-কে। রাজীব হত্যার পর হঠাৎই তাঁরা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসে। কিন্তু শেষের দিকে আম্মা নিজেই তো বার বার বিভিন্ন সময়ে তামিল জাত্যাভিমান উস্কে ভোটের বাজারে সুর নরম করে রাজীব হত্যাকারীদের পাশেই দাঁড়িয়েছেন।”
যুযুধান দু’পক্ষের কথা থেকে স্পষ্ট, তামিল রাজনীতিতে এখনও সেই জাত্যাভিমান এবং স্বশাসনের দাবি সুপ্ত হলেও যথেষ্ট জোরাল। তাই মূলস্রোতে থাকা কোনও রাজনৈতিক দলই এর বিরোধীতা করার সাহস পায় না। বরং রাজনীতির ঘোলা জলে প্রভাকরণ এবং তামিল স্বাভিমান উস্কে রেখে তামিল ভূমে রাজনৈতিক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন সিমানরা।