Lok Sabha Election 2019

গ্রামের বুকে বেঁচে আছেন রামদাস, কিন্তু বিদর্ভে এখনও নেভেনি জঠরের আগুন

ভোটের হাওয়া কেমন? কাছের চৌমাথার ভিড় বলতে থাকে, একেবারেই নেই।

Advertisement

তাপস সিংহ

যবতমাল, বিদর্ভ (মহারাষ্ট্র) শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৯ ১৬:০০
Share:

রামদাসের স্ত্রী সরস্বতী দেবী। ছবি: সংগৃহীত।

বধ্যভূমিতে আপনাকে স্বাগত! তেলঙ্গ টাকলি গ্রামে ঢোকার মুখে বিশুদ্ধ মরাঠিতে স্থানীয় যুবক আকাশ ভাসাওয়াত যা বললেন, তার বাংলা অর্থ এটাই।

Advertisement

নাগপুর শহর থেকে প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামে আসার কারণই অবশ্য রামদাস অম্বরওয়াড়। তিনি ও তাঁর মতো অসংখ্য কৃষক এই বিদর্ভের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে আছেন। বিদর্ভের ‘বধ্যভূমি’ শিরোপা পাওয়ার পিছনে তাঁদের সকলেরই ভূমিকা আছে।

পিচ বাঁধানো রাস্তা ছেড়ে ডান হাতের সিমেন্ট বাঁধানো পথ ধরে এগিয়ে গেলেই বাঁ হাতে রামদাসের বাড়ি। উঠোনের ডান হাতে খোলা রান্নাঘর, বলাই বাহুল্য, সে রান্নাঘর বাহুল্য বর্জিত। দু’বেলা ঠিকঠাক খাবার পেটে যাওয়া নিয়ে কথা, কাঠের উনুনটার কষ্ট কম।

Advertisement

আরও পড়ুন: এসপি-বিএসপি জোটে ধাক্কা, যোগীর দুর্গ-জয়ী নিষাদ পার্টি হাত মেলাল বিজেপির সঙ্গে​

সোজাসুজি লম্বাটে দালান ঘিরে ছোট একটা বসার ঘরের আদল। ডান দিকে সিঙ্গল খাট। কাঠের গদি দেওয়া তিনটি চেয়ারও আছে সেখানে। দালান-ঘরের এক কোনায় একটি বড় ঝুড়িতে মা-মুরগি আর তার সদ্য ফোটা ছানারা দানা খেতে ব্যস্ত। পাশের ঝুড়িতে দ্বিখণ্ডিত একটি কাঁচা ডিম।

আর ঘরের বাঁ প্রান্তে দেওয়ালে ফ্রেমবন্দি রামদাস তাকিয়ে আছেন ভিন রাজ্যের অতিথির দিকে!

বিদর্ভের নানা প্রান্ত ছেড়ে রামদাসের বাড়িতে আসা কেন?

কারণ, ১৯৯৭-এর ডিসেম্বরে কীটনাশক খেয়ে মৃত্যুকে অসময়ে আমন্ত্রণ জানানো রামদাস বাইরের পৃথিবীকে এই বিদর্ভ অঞ্চলের দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করেছিলেন। তার আগে বিদর্ভের চাষিদের নিদারুণ অবস্থার কথা সে ভাবে সবাই জানত না। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে রামদাস অন্তত জীবনকে আর টানতে পারছিলেন না।

সে দিন বেলা ১২টা নাগাদ পড়শির বাড়ি গিয়ে রামদাস জানিয়েছিলেন, তিনি চাষের কাজ রাখা কীটনাশক খেয়েছেন। চিকিৎসার বড় একটা সুযোগ মেলেনি।

কুড়ি বছর আগে মেয়েকে কোলে নিয়ে সরস্বতী দেবী।ছবি: সংগৃহীত।

আরও পড়ুন: ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ লেখা কাপে চা, ফের বিতর্কে ভারতীয় রেল​

তাঁর স্ত্রী এখন প্রৌঢ়া। সাদাসিধে চেহারার সরস্বতী জীবনের প্রতিটি দিনের পরীক্ষা দিতে ব্যস্ত। মাস দুয়েক আগেই বাইপাস সার্জারি হয়েছে তাঁর। পরনে সস্তার ছাপা শাড়ি, উল্টো দিকের চেয়ারে বসে সরস্বতী জানাতে থাকেন, স্বামী রামদাস চলে যাওয়ার সময় তাঁদের তিন মেয়ের বয়স ছিল আট, পাঁচ আর তিন বছর। মাথায় ছিল সব মিলিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকার ঋণ। পরের পর খরা, শেষ বছরটায় পোকায় শেষ করে দেয় তুলোর চাষ। পর পর তিন বছর এই অবস্থায় কেটেছিল রামদাসের। ঋণ শোধ করতে না পারায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে আসে ব্যাঙ্ক।কী ভাবে শোধ দেবেন এই টাকা? তাই সহজতর রাস্তাই বেছে নেন রামদাস।

তেলাঙ্গ টাকলি গ্রামে প্রায় ৪০০ ঘর। ভোটারের সংখ্যা হাজার চারেক। রামদাসের গ্রাম পড়ে যবতমাল লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে। এ বারেও এই কেন্দ্রে শিবসেনার হয়ে দাঁড়িয়েছেন ভাবনা পুন্ডলিকরাও গাওয়ালি। ২০০৯ এবং ২০১৪-য় এই কেন্দ্র থেকেই জেতেন তিনি। তাঁর বিপক্ষে কংগ্রেসের মানিকরাও গোবিন্দরাও ঠাকরে।

ভোটের হাওয়া কেমন? কাছের চৌমাথার ভিড় বলতে থাকে, একেবারেই নেই। কেউ সে ভাবে এই প্রত্যন্ত এলাকায় প্রচারেও আসেননি। আসবেন নিশ্চয়। এলে প্রতিশ্রতিও দেবেন! ভিড় বলতে থাকে, আমরা শুনবও সে সব। কিছু বলবেন না তাঁরা?

‘‘নিজেই তো ঘুরে দেখছেন সব। খরাপ্রবণ এলাকা। তার উপর পোকায় মারছে। তুলোচাষিদের মাথায় হাত। একের পর এক আত্মহত্যা। কোথায় যাব? কার কাছে যাব? ঋণ খেলাপ হল কোথায়? সরকারি চাকরি কোথায়? এই যে ছেলেপুলেরা স্কুলে পড়ছে, তারা এর পর কী করবে? এর পরেও আর কী বলব?’’ ক্ষোভ ঠিকরে বেরোয় আকাশ ভাসাওয়াত ও তাঁর বন্ধুদের গলা থেকে।

বিদর্ভের এই খরার ছবি সাম্বত্সরিক। ছবি: রয়টার্স।

আরও পড়ুন: সারা বিশ্বে ঘুরেছেন, এক বারও বারাণসীতে আসার সময় পাননি! মোদীকে কটাক্ষ প্রিয়ঙ্কার​

রামদাস আত্মহত্যা করার পরে ধীরে ধীরে বোঝা যায়, তাঁর মেজ মেয়ে মীনাক্ষী মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন। সাধ্যমতো চিকিৎসাও শুরু হয়। সাময়িক সুস্থ হওয়ার পরে তাঁকে অন্ধ্রপ্রদেশে বিয়েও দেন সরস্বতী। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে ধীরে ধীরে ফের প্রকট হতে থাকে তাঁর মানসিক অসুস্থতা। দুই শিশুসন্তান-সহ তাঁকে বাপের বাড়িতে রেখে যান শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। সে-ও হয়ে গেল কয়েক বছর। দুই নাতিকে তেলঙ্গ টকলিতেই পড়াশোনা করাচ্ছেন সরস্বতী। পাশে বসে সব শোনেন মীনাক্ষী। তাকিয়ে থাকেন নাগাড়ে। কিন্তু সে চোখে ভাষা যেন হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ!

সরস্বতী নিজে দিনমজুরি করে দৈনিক ১৫০ টাকা করে পেতেন। কিন্তু অপারেশনের আগে থেকেই সে রোজগার বন্ধ। এখন সম্বল বলতে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে একেবারেই অস্থায়ী কাজে তাঁর ছোট মেয়ের মাসিক তিন হাজার টাকা বেতন। তাতেও যাতায়াত আর টিফিন খরচে অনেকটাই বেরিয়ে যায়।

সর্বগ্রাসী হাহাকার। তবু, হারানোর বেদনার সঙ্গেই রামদাসের প্রতি কৃতজ্ঞ গ্রামের মানুষ। কারণ, নিজের জীবন দিয়ে সেই প্রথম বিদর্ভের কৃষকের অজানা আখ্যান বাইরের বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছিলেন রামদাস। তার পরেই বিদর্ভের করুণ ছবি দেখতে পায় তামাম দেশ।

বিদর্ভে করুণ অবস্থা তুলো চাষিদের।—ফাইল চিত্র।

আরও পড়ুন: পাকিস্তান এখনও লাশ গুনছে, বিরোধীরা প্রমাণ চাইছেন, মোদীর নিশানায় বিরোধীরা​

‘‘কত লোক এসেছিল তখন! কত ভিড় থাকত।’’ আর এখন? হাহাকারের রাজত্বে বিউটি পার্লারের ঠাঁই নেই, তবু ম্লান হাসিতেও অনন্য হয়ে ওঠেন সরস্বতী। মরাঠিতে বলেন, ‘‘এখন কে আসবে? আপনি সেই বাংলা থেকে এসেছেন! বাইরে বড় রোদ। একটু লেবুর জল খেয়ে যান।’’

এত রোদেও বাইরে হাঁ করে থাকে সর্বগ্রাসী অন্ধকার...আর তার মাঝেই সরস্বতীর দেওয়া লেবুর জল যেন অনন্ত বারিধারা হয়ে ছড়িয়ে যায় তেলঙ্গ টকলির সীমানা ছাড়িয়ে গোটা বিদর্ভের আকাশে!

(কী বললেন প্রধানমন্ত্রী, কী বলছে সংসদ- দেশের রাজধানীর খবর, রাজনীতির খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন