লড়াই এসপি-র, বদলার ডাক বিজেপির

বিজেপির প্রদেশ মন্ত্রী প্রকাশ পালের পাল্টা দাবি, ‘‘কন্নৌজে পায়ের তলার জমি সরে গিয়েছে এসপি-র। এই আসন স্রেফ গায়ের জোরে ধরে রেখেছে তারা। কিন্তু যা হাওয়া, তাতে এ বার পতাকা উড়বে বিজেপিরই।’’

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

কন্নৌজ শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৫১
Share:

ডিঙির অপেক্ষায় নদীর ধারে রামকিশোর কশ্যপ। নিজস্ব চিত্র

গঙ্গার বুকে জেগে থাকা এক ফালি চরে কুমড়োর চাষ। বন্যার জল জমি গিলে খেলে তা-ও বন্ধ। এটুকুতে ভর করেই ৩৫ বছর সংসার টানছেন রামকিশোর কশ্যপ। বাবাজির আশ্রমের ঘাট থেকে নৌকা চড়ে তাঁর জমিতে পা দিতেই ‘নমস্তে’ বা ‘রাম রাম’ নয়, ভেসে এল ‘জয় হিন্দ, জয় ভারত!’

Advertisement

ডিঙির অপেক্ষায় নদীর ধারে কুমড়ো ডাঁই করে রাখা রামকিশোর মজেছেন নরেন্দ্র মোদীতে। গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন বালাকোট, শৌচালয়, গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি ইত্যাদি। স্পষ্ট জানাচ্ছেন, এই চরের জমি খাতায়-কলমে তাঁর নয়। তাই চাষির অ্যাকাউন্টে বছরে ২,০০০ টাকার তিন কিস্তি তাঁর নামে আসবে না কখনও। কিন্তু তবু বিজেপি, থুড়ি মোদীকেই ভোট দেবেন তিনি। বুক ঠুকে এ কথা বলছেন অশোক কশ্যপ, বিনোদ সিংহরাও।

কানে যেতেই পাশের জমিতে আধ কাটা গম আর কাস্তে ফেলে ছুটে এলেন অরবিন্দ পাল, পাপ্পু পাল, হরি শঙ্কররা। মাঝ দুপুরের ঠা ঠা রোদের থেকেও বেশি গনগনে তাঁদের ক্ষোভের আঁচ। কেন্দ্রে মোদী আর রাজ্যে যোগী সরকারের যুগলবন্দিতে চাষিরা কেন মরতে বসেছেন, তার যুক্তি দিচ্ছেন তাঁরা।

Advertisement

হাড্ডাহাড্ডি ভোট-যুদ্ধের কন্নৌজে আপনি স্বাগত।

এমনিতে লখনউ থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরের এই আসনে ষাটের দশকে সাংসদ ছিলেন রামমনোহর লোহিয়া। ১৯৯৬ সালে শেষ বার জিতেছে বিজেপি। ১৯৯৮ থেকে এখানে সমাজবাদী পার্টির একচেটিয়া দাপট। খোদ মুলায়ম জিতেছেন। তাঁর পরে এখান থেকে জিতেই প্রথম বার সংসদে পা রেখেছেন ছেলে অখিলেশ যাদব। গত দু’বার বিজয়িনী অখিলেশের স্ত্রী ডিম্পল যাদব। এ বারও প্রার্থী তিনি। এসপি-র স্থানীয় নেতা এবং সাংসদ প্রতিনিধি নবাব সিংহ যাদবের মতে, এই আসন মুলায়ম পরিবারের খাস তালুক। দলের ‘নাক কা সওয়াল’। অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন (২০১২-১৭) এখানকার উন্নতির জন্য যা করেছেন, তা মনে রেখেই সাইকেল চিহ্নে ভোট পড়বে বলে তাঁর দাবি। সঙ্গে মায়াবতীর দলিত ভোট আছে। ভোট ভাগ রুখতে প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেসও।

বিজেপির প্রদেশ মন্ত্রী প্রকাশ পালের পাল্টা দাবি, ‘‘কন্নৌজে পায়ের তলার জমি সরে গিয়েছে এসপি-র। এই আসন স্রেফ গায়ের জোরে ধরে রেখেছে তারা। কিন্তু যা হাওয়া, তাতে এ বার পতাকা উড়বে বিজেপিরই।’’

বিজেপির স্থানীয় নেতাদের যুক্তি, ২০১২ সালে অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর খালি হওয়া এই আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতেন ডিম্পল। অভিযোগ, বিজেপি প্রার্থীকে রাস্তায় আটকে রেখে মনোনয়নই জমা দিতে দেননি এসপি সমর্থকরা। ২০১৪-তে ডিম্পলের কাছে মাত্র ১৯ হাজার ভোটে হেরেছিলেন বিজেপির সুব্রত পাঠক। এ বারেও প্রার্থী তিনি। বিজেপি নেতাদের দাবি, ‘‘আগের বার ভোট গণনার শেষ দিকে গণনাকেন্দ্র থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল বিজেপি সমর্থকদের। এমনকি প্রার্থীকেও। তার পরেই পাল্টে যায় ভোটের গুনতির ধারা।’’ সেই ‘অন্যায়ের বদলা’ নিতে এ বার তৈরি বিজেপি।

প্রকাশ বলছেন, ‘‘কন্নৌজ লোকসভার পাঁচটি বিধানসভার মধ্যে চারটিই বিজেপির কব্জায়। রসুইয়াবাদ, বিধুনা, তিরুয়া আর ছিবরামো। একমাত্র কন্নৌজ বিধানসভাই এসপি-র দখলে। তা-ও সেখানে জয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ২,৪০০। এ বার ডাক এসপি-মুক্ত কন্নৌজের।’’ পাল্টা হিসেবে এসপি শিবির বলছে, ‘‘নিজের শেষ ভোটে ঘরের বউকে হারতে দেবেন মুলায়ম? এমনিই কি এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন অখিলেশ?’’ চাষিদের দুর্দশা, বেকারত্ব, আর মোদীর ফাঁপা প্রতিশ্রুতি ধরা পড়ে যাওয়াই এখানে ডিম্পলের জয়ের পথ মসৃণ করবে বলে ধারণা তাঁদের।

এই তাল ঠোকাঠুকির মধ্যে দু’দল সম্পর্কেই ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন মানুষ। হরিশ যাদব, ঘনশ্যাম, ভানুপ্রকাশ মিশ্র, রাজু গুপ্তদের অভিযোগ, চাষিদের দুর্দশা চরমে। ডিজেলের দাম বেড়েছে, তাই চড়েছে সেচের পাম্পের ভাড়া। যে টাকা বীজ বোনা, সার, সেচ, কীটনাশকে খরচ হয়, ফসল বেচে সেটুকু তোলাই কঠিন হচ্ছে অনেক সময়ে। সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বেঁধে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার বড় অংশ চলে যায় সরকারি কর্তা আর দালালদের তুষ্ট করতে। ঘুষ মিটিয়ে যা ঘরে আসে, তাতে সংসার চালানো দায়। ফলে হয় কিসান ক্রেডিট কার্ডে ধারের অঙ্ক বাড়তে থাকে, নয়তো সুদ আদায়ে লেঠেল পাঠায় মহাজন।

সুগন্ধির জন্য কন্নৌজ যেমন বিখ্যাত, তেমনই পরিচিত আলু চাষের কারণেও। অজিত কুমার, মহেশ সিংহরা বলছেন, ‘‘প্রতি বছর ভাল দামের আশায় হিমঘরে আলু রাখেন চাষিরা। কিন্তু অধিকাংশ বারই দর পড়ে গেলে ভাড়া গুনে তা আর ছাড়াতেই আসেন না অনেকে। হিমঘরের ‘পয়সাওয়ালা’ মালিক ভিন্‌ রাজ্যে সেই আলুর বাজার ঠিক খুঁজে নেন। কিন্তু রোজ পাওনাদারের তাগিদা আর অপমানে জেরবার হয়ে শেষে এক দিন গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখা যায় চাষিকে।’’

সর্বেশ কুমারের কথায়, ‘‘টাকার অভাবে কারও মেয়ের বিয়ে আটকে, কেউ সারাতে পারছেন না ফুটো ছাদ। তার উপরে রোজ পাওনাদারের অপমান। তার জায়গায় মরতে পারলে অন্তত ৫ লক্ষ টাকা মেলে। বাড়ির দরজায় এসে হাতে থোক টাকা গুঁজে দিয়ে যান নেতারা। কপাল ভাল থাকলে বাড়িও হয়। কে জানে আত্মহত্যার আগে সে হিসেব কেউ কষেন কি না!’’

দিনভর খেতে মেহনত করেও সংসার চলে না, তার উপরে রাতের
ঘুম কেড়েছে গরু। যোগী সরকারের নিদানে বুড়ো গরু বেচার জো নেই। অথচ তার খাবার ভুষির কুইন্টাল ৫০০ থেকে ১,৫০০ টাকা। ফলে চরে খেতে রাতে গরু ছেড়ে দেন অনেকে। অগত্যা ফসল বাঁচাতে রাত-পাহারা। অনেকেরই দাবি, ‘‘খাতায়-কলমে গোশালা তৈরি হচ্ছে রোজই। কিন্তু তার অনেক জায়গাতেই গরু তো দূর, ছাউনিই নেই!’’ দুর্নীতির গন্ধ ‘গোমাতা’কে ঘিরে।

পাল্টাও আছে। কন্নৌজের রাস্তায় কান পাতলেই শোনা যায়, কী ভাবে শুধু জাত বিচারের ভিত্তিতে চাকরি থেকে শুরু করে সব সুবিধা দিয়েছে এসপি সরকার। মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে তুষ্ট করতে কী ভাবে তাদের অন্যায়ে চোখ বন্ধ করে থেকেছে প্রশাসন।

এমনিতে মুলায়ম পরিবারের বড় বউ ডিম্পলকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখে এই এলাকা। পছন্দ করে তাঁর সংস্কারকে। অনেকেই বললেন, ডিম্পলকে ঘরে আনতে প্রথমে তীব্র আপত্তি ছিল মুলায়মের। বিয়ে মেনে নিতে বলায় নাকি নিজের দলের এক মন্ত্রীকেই দু’দিন ঘরবন্দি করে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু পুণের সেনা অফিসারের বাড়িতে জন্মানো সেই মেয়েই পরে হয়ে উঠেছেন নেতাজির পরিবারের প্রাণভোমরা। অখিলেশের ছায়াসঙ্গিনী। লাল্লু যাদবরা তাই তাঁকে জেতাতে মরিয়া। কিন্তু তেমনই মান সিংহদের ক্ষোভ, ‘‘বড় বাড়ির বউ। আমরা তো পৌঁছতেই পারি না তাঁর কাছে। গত সাত বছরে কেন্দ্রে এসেছেন বড়জোর বার দশেক।’’ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির অভিযোগও মজুত।

অনেকে বলছেন, এই হাড্ডাহাড্ডি টক্করে শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর নাম ঠিক করে দেবে দলিত ভোটই। মোট ১৮ লক্ষ ৫৩ হাজার ভোটারের এই কেন্দ্রে দলিত ভোট প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ। মায়াবতীর জোট-বার্তায় ৮৫-৯০ হাজার জাটভ ভোট যাবে ডিম্পলের বাক্সে। কিন্তু বাকিদের (নিষাদ, কাহার, পাল, নাই ইত্যাদি) ভোট কোন দিকে হেলবে, তা স্পষ্ট নয় এখনও। জেতা-হারা নাকি ঠিক হবে ওতেই।

‘‘তবে যে-ই জিতুন, সেই কুমড়ো বেচেই দিন চলবে আমার’’— বক্তার নাম? রাম কিশোর কশ্যপ!

জয় হিন্দ। জয় ভারত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন