ত্রস্ত উন্নাও, গর্ব শুধু ‘রোমিয়ো’ ধরায়

অভিযান বেটি বচাও। জয়ধ্বনি ভারতমাতার। কিন্তু কেমন আছেন মেয়েরা

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

লখনউ (উত্তরপ্রদেশ) শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৪১
Share:

ধর্ষিতার ভাঙা বাড়ির ফাঁক দিয়ে সেই মন্দিরের চুড়ো। নিজস্ব চিত্র

পিচ রাস্তার বাঁ হাতে মাখি থানাকে রেখে আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকে ঢুকতে হল। গুগল ম্যাপ ফেল মেরে গিয়েছিল আগেই। কিন্তু অচেনা লোককে মাখি গ্রামের হদিস দিতে মানুষের বড় ভয়, বড় আতঙ্ক। অনেক উপরোধে একজন রাস্তা চেনাতে রাজি হলেন। শর্ত একটাই, দূর থেকে গ্রামটা দেখিয়ে দেবেন। ভিতরে ঢুকবেন না।

Advertisement

আতঙ্কের নাম ঠাকুর কুলদীপ সেঙ্গার। উন্নাওয়ের বিজেপি বিধায়ক। কুখ্যাত উন্নাও ধর্ষণ মামলার অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে আপাতত গারদে। ধর্ষিতার বাবাকে হত্যার অভিযোগে বন্দি কুলদীপের ভাই অতুলও। আতঙ্কের মাত্রা দেখে যদিও তা বোঝার উপায় নেই।

গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে বড়সড় একটা স্কুলবাড়ি। তার পিছনে লোহার অতিকায় ফটকের ভিতর থেকে মন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে। স্কুলের পাশ দিয়ে এগিয়ে একটি পরিবারকে জিজ্ঞাসা করতেই দুই মহিলা আর এক পুরুষ হাতজোড় করলেন। ত্রস্ত গলায় বললেন, ‘‘আমরা নিচু জাত। ঠাকুরদের ভিতরকার গোলমালে আমরা কী করব বলুন! কুলদীপ সেঙ্গার খুব ভাল লোক। ওই মন্দির তো ওদেরই, ওর ভিতরেই বাড়ি! স্কুলও ওদের! আর আপনি যাকে খুঁজছেন, তার বাড়ি মন্দিরের পিছনে! যান, পুলিশ আছে!’’

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

একেবারে ভাঙাচোরা বাড়িটা। ছাদগুলো খসে পড়ছে। তারই সামনে একটা ইমারতের চাতালে সার দিয়ে খাটিয়ায় মশারি টাঙিয়ে অন্তত বারো-চোদ্দো জন পুলিশ। উন্নাও মামলা এখন সিবিআইয়ে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির জন্য পুলিশ পাহারা। গোবর মেখে ঘুঁটে দেওয়ার তোড়জোড় করছিলেন মা। ছোট মেয়েটি দরজা খুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠে এলেন। পরিচয় দিতে যা বাকি ছিল। জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললেন।

‘‘মেয়েটার যে কী অবস্থা করেছিল দিদি...পুলিশ যখন ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ওকে নিয়ে যাচ্ছে, আমি মা হয়ে তাকিয়ে দেখতে পারিনি। মেয়ের বাবাকে যেদিন ওরা ধরে নিয়ে গেল, ওই মন্দিরওয়ালা বাড়ির ভিতরে একটা নিমগাছ আছে। ওটার সঙ্গে ওকে বেঁধে মোটরের জল ছেড়ে দিল। বন্দুকের নল দিয়ে কুঁদে কুঁদে মেরে ফেলল, দিদি। পুলিশ যখন ওকে নিয়ে যাচ্ছে, আঙুল ঠেকিয়ে টিপছাপ নিচ্ছে, ও আসলে তখনই মরে গিয়েছিল। পুলিশ মরার কথাটা মানল পাঁচ দিন পরে। আমার সহায় বলতে ছিল দেওর। তাকে ভুয়ো মামলা দিয়ে পুরে দিল। আমি এখন একেবারে একা। ওই মেয়ে দিল্লিতে আছে। বাকি তিন মেয়ের বিয়ে দেব কী করে? ছোট্ট ছেলেটাকে পড়ানো, মামলা চালানো আর খাওয়াদাওয়ার জোগাড়ই বা হবে কী করে! বাড়িটা ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। বিঘে দুই জমি ছাড়া আমার আর কিছু নেই। কুলদীপের ভয়ে এখানে সবাই কাঁপে। গাঁয়ের লোকেরা পারতপক্ষে আমাদের সঙ্গে কথা বলে না।’’

থামের ও-পাশে মারমুখী রক্ষীরা। এ-পাশে সিঁটিয়ে অন্য এক যুগল। লখনউ রেসিডেন্সির দৃশ্য। নিজস্ব চিত্র

গত বছর কাঠুয়া মামলার সঙ্গে প্রায় একত্রেই সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছিল উন্নাও। ধর্ষণের ঘটনাটা যদিও আরও এক বছর পুরনো। প্রথমে পড়শিনি শশী সিংহের ছেলে ও গাড়িচালকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, মেয়েটিকে বেচে দেওয়ার অভিযোগ। তার পর খোদ বিধায়কের দিকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠতেই বেঁকে বসে পুলিশ। গত এপ্রিলে যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির সামনে ধর্ষিতার গায়ে আগুন দেওয়ার চেষ্টা আর পরের দিন পুলিশ হেফাজতে মেয়ের বাবার মৃত্যুতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল দেশ। কিন্তু সেঙ্গারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস আজও গ্রামবাসীদের হয়নি। পীড়িত পরিবারটিও ঠাকুর, কিন্তু দরিদ্র। ফলে ক্ষমতাশালী ঠাকুরের হাতেও তারা বিপর্যস্ত, আবার ভিন জাতের কাছেও আপন নয়।

প্রশ্ন হল, যোগীজি তবে নারী সুরক্ষার বড়াই করেন কিসের ভিত্তিতে? চোখের সামনে মালুম হল সেটাও। ‘‘কোলে বাচ্চা নিয়ে এই সব...লজ্জা করে না?’’ কথাগুলো যার উদ্দেশে বলা হচ্ছে, সেই ব্যক্তির কোলে সত্যিই একটি দুধের শিশু। চিৎকার করে কান্না জুড়েছে। এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ঘামছেন এক তরুণী। আর ধাঁইধপাধপ চড়থাপ্পড় খাচ্ছেন এক যুবক। নিরাপত্তারক্ষীরা ঘিরে ধরেছেন তাঁকে। রক্ষীদের সন্দেহ, ষড় করে দেহব্যবসা চলছে!

ঘটনাস্থল লখনউয়ের বিখ্যাত ব্রিটিশ রেসিডেন্সি চত্বর। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা সল্টলেকের বনবিতানের মতোই প্রেমিক-প্রেমিকাদের অতি পছন্দের জায়গা। যোগীর অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াডের-ও। রক্ষীদের একজনই সগর্বে জানালেন, আগে দিনে হাজারের কাছাকাছি টিকিট বিক্রি হত। এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে তিনশ-চারশতে। ‘‘বুঝে নিন কেন! গন্ধি হরকত করার জন্যে যারা আসত, তারা আর আসে না। ২৮ জন পাহারাদার এখন। আগের যুগ হলে চোখে হাত চাপা না দিয়ে চলতে পারতেন না!’’

আগের যুগ মানে, যোগী-পূর্ব যুগ। এ বারের নির্বাচনী প্রচারে মেরঠের প্রথম সভাতেই খোদ প্রধানমন্ত্রীও বলে গিয়েছেন, যোগীর আমলে মেয়েরা নিরাপদ। গোড়ার দিকে রোমিয়ো স্কোয়াড দিনে ৬টা করে ‘কেস’ জমা করত। কিন্তু সচিবালয়ের কর্তারাও একান্তে স্বীকার করছেন, সে সবের আদ্দেকই ভুয়ো। নম্বর বাড়ানোর আগ্রহে স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, সহকর্মী কাউকে ছাড়া হয়নি। সেপ্টেম্বরে নীতি পুলিশের গুলিতে অ্যাপ্‌ল-কর্মী বিবেক তিওয়ারির মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে অতি সক্রিয়তা কিছু কমেছে।

অথচ মেয়েদের সুরক্ষায় যে কাজটা সত্যিই ফলপ্রসূ হয়েছে, সেটা ১০৯০। ফোনে, সাইবার দুনিয়ায় হয়রানি রোখার— হেল্প নয়, ওঁরা বলেন, পাওয়ারলাইন। উদ্যোগটা যেহেতু অখিলেশের, তাই যোগীর প্রচারে সেটা তত আসে না। অথচ শহরের একটা মোড়ের নামই এখন ১০৯০। সেখানেই দফতরের বিশাল ঝাঁ চকচকে অফিস। শুধু ১০৯০-এর জন্যই ২০০ পুলিশ। গত এক বছর হল, হাল ধরেছেন দাপুটে আইপিএস অঞ্জু গুপ্ত। নামটা চেনা লাগতে পারে। কারণ, এই অঞ্জুই বাবরি মামলায় আডবাণীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। বললেন, ‘‘আমরা শুধু এ বছরেই এখনও অবধি প্রায় ৬৪ হাজার অভিযোগ পেয়েছি, ব্যবস্থা নিতে পেরেছি ৫৪ হাজারেরও বেশি। প্রযুক্তি আরও উন্নত হচ্ছে। এখন শুধু হয়রানি ছাড়াও কেউ যদি সরাসরি আক্রমণের অভিযোগও আমাদের কাছে ফোনে জানান, সঙ্গে সঙ্গে তা বিশেষ অ্যাপ মারফত সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছে যাবে।’’

কিন্তু এত অভিযোগ আসাও তো কম দুশ্চিন্তার নয়! অঞ্জু একটু থেমে বললেন, ‘‘পরিসংখ্যান নিয়ে হইচই করলে তো পুলিশ আরওই কেস নিতে চাইবে না! আমি সবাইকে বলছি, চুপ্পি তোড়ো! নীরবতা ভাঙো!’’

অঞ্জুর হাতে পড়লে কি উন্নাও মামলার গতি অন্য রকম হত? প্রশ্নটা করার অনুমতি ছিল না। সব প্রশ্নের জবাব হয়ও না। ‘‘জিন্দেগি কিঁউ ইতনি ভারী পড় গয়ী দিদি?’’ উন্নাওয়ের মা কি এর জবাব পাচ্ছেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন