মৃত্যু কমলেও জোরালো ধাক্কা সম্পত্তি-শস্যে

পাঁচ দিন ধরে আশঙ্কার প্রহর গুনছিল পূর্ব উপকূল। শেষ পর্যন্ত রবিবার সকালে আছড়ে পড়ল অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ। আগে থেকে জানা গেলে এবং ঠিক মতো প্রস্তুতি নিলে যে ব্যাপক প্রাণহানি রোখা যায় আরও এক বার তার প্রমাণ মিলল। তবে সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য কমানো যায়নি। অন্ধ্র ও ওড়িশা, দু’রাজ্যেই শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে ঝড়ের আর্থিক ধাক্কাটা কিন্তু সে ভাবে সামলানো যায়নি।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

বিশাখাপত্তনম শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৭
Share:

হুদহুদের দাপটে উত্তাল সমুদ্র। আর তাতেই ভেসে যাচ্ছিলেন স্ত্রী। জলে ঝাঁপ দিয়ে স্ত্রীকে তুলে আনলেন স্বামী। ওড়িশার গোপালপুরে। ছবি: রয়টার্স

পাঁচ দিন ধরে আশঙ্কার প্রহর গুনছিল পূর্ব উপকূল। শেষ পর্যন্ত রবিবার সকালে আছড়ে পড়ল অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ। আগে থেকে জানা গেলে এবং ঠিক মতো প্রস্তুতি নিলে যে ব্যাপক প্রাণহানি রোখা যায় আরও এক বার তার প্রমাণ মিলল। তবে সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য কমানো যায়নি। অন্ধ্র ও ওড়িশা, দু’রাজ্যেই শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে ঝড়ের আর্থিক ধাক্কাটা কিন্তু সে ভাবে সামলানো যায়নি।

Advertisement

আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস মতোই আজ বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে আছড়ে পড়ে হুদহুদ। আশঙ্কা ছিল ১৯৫। তবে আজ ঘণ্টায় ১৭৫ কিলোমিটার গতিতে ধেয়ে আসে আন্দামান সাগরে ঘনীভূত হওয়া এই ঝড়। শুধু অন্ধ্র নয়। ঝড়ের জেরে তছনছ হয়ে গিয়েছে ওড়িশার একটি বড় অংশও। দু’টি রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলা বিধ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু হয়েছে মাত্র ছ’জনের।

অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এই জাতীয় ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে থাকে। হুদহুদে সেটা হয়নি বলে দুই রাজ্যের প্রশাসনিক তৎপরতাকেই বাহবা দিচ্ছেন সকলে। আসলে গত বছরের পিলিনই পথ দেখিয়েছে এ ক্ষেত্রে। আগে থেকে দুই রাজ্য মিলিয়ে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষকে সরিয়ে ত্রাণ শিবিরে নিয়ে যাওয়ার ফলেই ব্যাপক প্রাণহানি কমানো গিয়েছে।

Advertisement

আজ সকালে হুদহুদ আছড়ে পড়ার পর থেকে অনেকের মুখেই ঘুরে-ফিরে উঠে এসেছে ওড়িশার সুপার সাইক্লোনের প্রসঙ্গ। অতি প্রবল সেই ঘূর্ণিঝড়ের ধাক্কায় সে বার মারা গিয়েছিলেন প্রায় দশ হাজার মানুষ। আয়লার স্মৃতিও ভয়ঙ্কর। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেই ঝড়ে। কিন্তু তার পর থেকেই বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। পূর্বাভাস পাওয়ার প্রক্রিয়াও ক’বছরে অনেক আধুনিক হয়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রশাসনিক তৎপরতা। গত বছর পিলিনের সময় আগাম সতর্কতা নেওয়ার ফলেই প্রাণহানি কমানো সম্ভব হয়েছিল। হুদহুদের বেলাতেও সেটাই হয়েছে।


হুদহুদে উত্তাল সমুদ্র। রবিবার বিশাখাপত্তনমে। ছবি: পিটিআই

পাঁচ দিন ধরে তিলে তিলে তৈরি হয়েছিল হুদহুদ। ফলে ওড়িশা আর অন্ধ্র সরকার যথেষ্ট সময়ও পেয়েছে প্রস্তুত হতে। বড় সংখ্যায় প্রাণহানি না হলেও খানিকটা বিষণ্ণ অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু। “এক জনেরও মৃত্যুও চাইনি আমরা। তবু কিছু দুর্ঘটনা তো আমাদের হাতে থাকে না,” আক্ষেপ তাঁর। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, ঝড় সম্পূর্ণ তছনছ করেছে গোটা বিশাখাপত্তনম শহরটাকে। রাস্তায় রাস্তায় উপড়ে পড়েছে গাছ। উড়ে গিয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি। বিধ্বস্ত অন্ধ্রপ্রদেশের একটি বড় অংশ। গোটা রাজ্যেই বিপর্যস্ত বিদ্যুৎ আর টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি জেলা। বিশাখাপত্তনম, শ্রীকাকুলাম এবং বিজয়নগরম। আগে ভাগেই গোটা রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকার মানুষজনকে ৩০০টি ত্রাণ শিবিরে নিয়ে যাওয়া হলেও এ রাজ্যে হুদহুদের বলি তিন। এর মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে গাছ পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যের দু’লক্ষ আটচল্লিশ হাজার মানুষ। ভেঙে পড়েছে ৭০টি বাড়ি। মারা গিয়েছে কিছু গবাদি পশু। চন্দ্রবাবু নায়ডু জানিয়েছেন, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর দফতর সূত্রে খবর, দফায় দফায় দুই রাজ্যের মুখ্যসচিবদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন মোদী। তাঁর নির্দেশে তৎপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহও। গোটা উদ্ধারকাজকে ‘অপারেশন লহর’ নাম দিয়েছে নৌসেনা।

হুদহুদের কোপে পড়েছে পড়শি রাজ্য ওড়িশাও। সেখানে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। পুরীতে মৃত্যু হয়েছে এক মৎস্যজীবীর। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক জানিয়েছেন, ছ’শোটি ত্রাণশিবিরে উপকূলবর্তী এলাকার মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্রাপড়া, গঞ্জাম, পুরী, কলাহান্ডি, কোরাপুট, গজপতির মতো এলাকা।

ওড়িশা ও অন্ধ্র দিয়ে যাতায়াত করে এমন ৫১টি ট্রেন বাতিল হয়েছে সারা দিনে। সমান বিপর্যস্ত উড়ান পরিষেবাও। আবহাওয়া দফতর সূত্রে খবর, এ বার ঝাড়খণ্ডের দিকে যাওয়ার কথা হুদহুদের। পথে হাওয়ার গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারে নেমে আসতে পারে। অন্ধ্রে আগামী তিন দিন ভারী বৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করেছে আবহাওয়া দফতর। ঝড়ের তেমন দাপট না থাকলেও আগামী তিন দিনে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে ঝাড়খণ্ডে। বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে বিহার, মধ্যপ্রদেশ আর গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গেও।

ভলভোটা দুলছিল যেন নৌকো
সংবাদ সংস্থা • বিশাখাপত্তনম ও কেন্দ্রাপড়া

ভলভো বাসের ভিতরে বসে প্রথমে বোঝেননি ঠিক কত জোরে হাওয়া বইছে। কিন্তু বিশাখাপত্তনমের বাসিন্দা শ্রীনিবাস জৈন হুদহুদের দাপট টের পান কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। তাঁর কথায়, “কিছু ক্ষণের মধ্যেই বাসটা নৌকার মতো দুলতে শুরু করল। চালক গতি কমিয়ে দিলেন। তার এক সেকেন্ডের মধ্যে বাসের দু’টি জানলার কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। বাইরে থেকে ধেয়ে এল বৃষ্টি।” শ্রীনিবাস জানাচ্ছেন, যাত্রীদের অনেকেই তখন ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছেন। সব দেখেশুনে চালক বাস থামিয়ে দিলেন। কিন্তু তাতেও স্বস্তি নেই। হুদহুদের তাণ্ডবে বাস দুলেই চলেছে।

উল্টো দিকে দাঁড়ানো এক ট্রাকের ড্রাইভার ভলভোর চালককে বললেন, ট্রাকের গা ঘেঁষে বাসটি পার্ক করলে উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। শ্রীনিবাসের মন্তব্য, “ভাঙা জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। কী রকম একটা ভুতুড়ে অভিজ্ঞতা। পরে জানলাম ঘণ্টায় প্রায় ১৯০ কিলোমিটার গতিতে হাওয়া দিচ্ছিল।”

প্রায় ছ’সাত ঘণ্টার তাণ্ডবে তছনছ বিশাখাপত্তনম। টিভির পর্দায় ভেসে উঠেছে শহরের কেন্দ্রে থাকা খাঁ খাঁ পেট্রোল-পাম্পের ছাদ পর্যন্ত কাঁপছে। অন্ধ্রপ্রদেশে সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিশাখাপত্তনমেই। ভেঙে গিয়েছে অধিকাংশ বাড়ির জানলা। গুজরাতের এক ব্যবসায়ী কাজের সূত্রে এখন বিশাখাপত্তনমের হোটেলে বন্দি। তিনি বলেন, “হাওয়ার শব্দে মনে হচ্ছিল বিস্ফোরণ হচ্ছে! সাইক্লোন যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে, জানতাম না।”

ওড়িশায় অন্য অভিজ্ঞতার কথা জানালেন এক প্রত্যক্ষদর্শী। মহিলা ও শিশু-সহ সাত জনকে বাঁচিয়েও সহদেব সামাল বাঁচাতে পারলেন না নিজেকে। কেন্দ্রাপড়ার ওকিলোপলা এবং সতভ্য গ্রাম থেকে মহিলা ও শিশুদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ চলছিল। এর মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা এক মহিলাও ছিলেন। বাউসাগাড়ি ছোট নদীর কাছে নৌকা যায় উল্টে। উদ্ধারে নামেন স্থানীয়রা। এঁদের মধ্যে ছিলেন সহদেব। তিনি কয়েক জনকে উদ্ধার করলেও তলিয়ে যায় ন’বছরের একটি মেয়ে। সহদেবও আক্রান্ত হন নিউমোনিয়ায়। আজ মারা যান তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন