‘চাঁদনি বার’ ছবির দৃশ্য।
বিতর্কটা দশ বছরের পুরনো। দেশের শীর্ষ আদালতের একটা রায়ে ফের শিরোনামে মহারাষ্ট্রের ডান্স বার।
ডান্স বারের উপর মহারাষ্ট্র সরকারের জারি করা নিষেধাজ্ঞায় আজ স্থগিতাদেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি দীপক মিশ্র এবং প্রফুল্লচন্দ্র পন্তের বেঞ্চ তাদের রায়ে বলেছে, ‘‘মহারাষ্ট্র পুলিশ আইনের (দ্বিতীয় সংশোধনী) ৩৩ নম্বর (এ) (১) ধারা জারির উপর স্থগিতাদেশ দেওয়াটাই যথাযথ বলে আমরা মনে করছি।’’ এই রায়ের ফলে এতগুলো বছর ধরে গোটা রাজ্যে নিষিদ্ধ ডান্স বারগুলি ফের চালু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যদিও এ বিষয়ে আগামী শুনানি ৫ নভেম্বর হবে বলে জানিয়েছে শীর্ষ আদালত। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে এ-ও বলেছে যে, ‘‘বারগুলিতে নাচ যাতে শালীনতার মাত্রা না ছাড়ায়, তাতে নারীদের মর্যাদা যাতে না ক্ষুণ্ণ হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে বার মালিকদেরই।’’ মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস অবশ্য এই রায় শোনার পরেই টুইট করে জানিয়েছেন, আদালত নির্দেশ দিলে তাঁরা ফের ডান্স বার চালু করবেন। কিন্তু এই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে ফের শীর্ষ আদালতে আবেদন জানাবেন তাঁরা। কারণ তাঁর সরকার এখনও ডান্স বার নিষিদ্ধ করারই পক্ষে।
বিতর্কের সূত্রপাত ২০০৫ সালে। সে বছর বম্বে পুলিশ আইনে সংশোধনী আনে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। উদ্দেশ্য, রাজ্য জুড়ে রমরমিয়ে চলতে থাকা ডান্স বারগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। রাজ্য সরকারের বক্তব্য ছিল, এই ডান্সবারগুলি অশালীনতা ছড়ায় এবং প্রকারান্তরে যৌন ব্যবসাকেই মদত দেয়। সেই সংশোধনী আনার মূল হোতা ছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর আর পাটিল। যদিও সেই আইনে ছাড় দেওয়া হয়েছিল তিন তারা ও পাঁচ তারা হোটেলগুলিকে। রাজ্য সরকারের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বম্বে হাইকোর্টে তখনই মামলা করে রেস্তোরাঁ ও বার মালিকদের একটি সংগঠন। ওই সংগঠনের বক্তব্য ছিল, বারগুলিকে নিষিদ্ধ করলে যৌন ব্যবসায় মদত দেওয়া তো কমবেই না। উল্টে বার নর্তকীদেরই পরোক্ষে যৌন পেশায় ঠেলে দেওয়া হবে। কারণ, রাজ্য জুড়ে প্রায় সাতশো ডান্স বারে পঁচাত্তর হাজার মহিলা কাজ করেন। সরকার এই বারগুলি নিষিদ্ধ করলে সংসার চালাতে তাঁদেরই দেহ ব্যবসাতেই নামতে হবে।
রাজ্য সরকার অবশ্য তাদের সিদ্ধান্তেই অনড় ছিল। কিন্তু রেস্তোরাঁ ও বার মালিকদের সংগঠনের পক্ষে করা আবেদনের প্রেক্ষিতে পরের বছরই অর্থাৎ ২০০৬ সালের এপ্রিলে মহারাষ্ট্র সরকারের এই সিদ্ধান্তকে বাতিল ঘোষণা করে বম্বে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট তার রায়ে জানায়, মহারাষ্ট্র সরকারের এই সিদ্ধান্ত আদতে ভারতীয় সংবিধানের ১৯ নম্বর (১) (জি) ধারার বিরোধী। সংবিধানের ওই ধারায় বলা আছে, ভারতীয় নাগরিকরা যে কোনও ধরনের পেশা বা ব্যবসায় নিযুক্ত হতে পারেন। বম্বে হাইকোর্টের এই রায়ের পরপরই অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্য সরকার।
প্রায় সাত বছর পরে, ২০১৩ সালের জুলাইয়ে বম্বে হাইকোর্টের সিদ্ধান্তই বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট। হাইকোর্টের সুরে শীর্ষ আদালতও তাদের রায়ে জানায়, মহারাষ্ট্র সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় সংবিধান-বিরোধী। এর পরে, ২০১৪ সালের জুন মাসে রাজ্য বিধানসভায় মহারাষ্ট্র পুলিশ (দ্বিতীয় সংশোধনী) বিল আনে সরকার। যেখানে তিন তারা আর পাঁচ তারা হোটেলগুলিকেও ডান্স বার চালানোর অনুমতি কেড়ে নেওয়া হয়। কোনও বিরোধিতা ছাড়া সেই বিল পাশ হয়ে যায় রাজ্য বিধানসভায়।
রাজ্য সরকারের এই কঠোর মনোভাব দেখে ২০১৪ সালের সংশোধনী আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় ‘ভারতীয় হোটেল এবং রেস্তোরাঁ সংগঠন’। সেই মামলার প্রেক্ষিতেই আজকের এই রায়। শীর্ষ আদালতের এই রায়ে খুশি মহারাষ্ট্রের হোটেল ও রেস্তোরাঁ সংগঠগুলি। সেই সঙ্গে বলিউডের এক ঝাঁক তারকাও এই স্থগিতাদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তাঁর ছবি ‘চাঁদনি বার’-এ বার নর্তকীদের জীবন কাহিনি তুলে ধরেছিলেন মধুর ভান্ডারকর। টুইটারে পরিচালক লিখেছেন, ‘‘মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি।’’ মধুর ছাড়াও এই সিদ্ধান্তে খুশি প্রীতীশ নন্দী, পুজা ভট্টের মতো ব্যক্তিত্বরা। অভিনেত্রী কঙ্কনা সেনশর্মা টুইট করেছেন, ‘‘মানুষ যদি বারে মেয়েদের নাচতে দেখতে চান, তা হলে সেটার অনুমতি দেওয়া উচিত। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বাস করি না।’’
তবে শুধু মাত্র স্থগিতাদেশের সিদ্ধান্তে গা ভাসাতে রাজি নন ভারতীয় হোটেল এবং রেস্তোরাঁ সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি মনজিৎ সিংহ শেট্টি। তিনি জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট যত ক্ষণ না স্থায়ী কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তত ক্ষণ কোনও পদক্ষেপ করা সম্ভব নয়। উল্টে ডান্স বার চালু করা নিয়ে সংশয়ই কাজ করছে তাঁর মনে। বললেন, ‘‘রোজগার হারানো মেয়েগুলোর জন্য সরকার যে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। জানি, কিছুতেই রাজ্যে ডান্স বার চালু করতে দেবে না এই সরকার।’’
সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারকে আজ এক হাত নিয়েছে বিরোধী দলগুলিও। রাজ্য বিধান পরিষদের বিরোধী দলনেতা ধনঞ্জয় মুন্ডের কথায়, ‘‘এটা তো আসলে মহারাষ্ট্র সরকারের নৈতিক আর প্রশাসনিক পরাজয়।’’ একই ভাবে ফডণবীসের সরকারকে দুষেছে এনসিপি-ও। তবে বিরোধীরা যা-ই বলুক, ডান্স বার খোলার পক্ষে যে তাঁর সরকারেরও সায় নেই, তা আজ ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ফডণবীস। মহারাষ্ট্র সরকার যে আইনের পথেই হাঁটবে, তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।